ট্রাম্পের টুইটার অ্যাকাউন্ট বাতিল ভবিষ্যতের জন্য অশনি সঙ্কেত

টুইটার, ফেসবুকের মতো টেক কোম্পানিগুলো যে সম্পূর্ণ নিজেদের সিদ্ধান্তে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী প্রেসিডেন্টের অ্যাকাউন্ট ব্লক বা রিমুভ করে দিতে পারছে, এটাকে এখনকার প্রেক্ষিতে খুব পজিটিভ ব্যাপার মনে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এটা খুবই ডেঞ্জারাস ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করছে।

ইউভ্যাল নোয়াহ হারারি তার 21 lessons for the 21st century বইয়ে ভবিষ্যতের পৃথিবীর কিছু চিত্র এঁকেছেন। এবং তার মতে আগামী দিনগুলোতে মূল ক্ষমতা ট্রাম্প-বাইডেনদের মতো প্রেসিডেন্টদের হাতে থাকবে না। থাকবে টেক কোম্পানিগুলোর হাতে। এবং সেই ক্ষমতা হবে আনলিমিটেড।

ভবিষ্যতের পৃথিবী রাষ্ট্রপ্রধানরা পরিচালনা করবে না। করবে টেক জায়ান্টরা এবং তাদের সিইওরা। এআই আর বায়োটেকের কল্যাণে বিশ্বের প্রতিটা মানুষ সম্পর্কে যে বিপুল পরিমাণ তথ্য তাদের হাতে থাকবে, তার সাথে টেক্কা দেওয়ার মতো অন্য কোনো সিস্টেম তখন থাকবে না। ডেমোক্রেসি আর ডিক্টেটরশিপের মধ্যেও কোনো পার্থক্য তখন থাকবে না। হারারির ভাষায়, দুই সিস্টেমের পার্থক্য থাকবে কেবল কিছু ডাটাসেটে, কিছু অ্যালগরিদমে। বাকি সব হবে হুবহু একই।

আধুনিক বিশ্বব্যবস্থাই হয়তো তখন পরিবর্তিত হয়ে যাবে। দেশগুলোর যে মানচিত্র এখন আছে, তখন সেটা থাকবে না। একাধিক দেশ একত্রিত হয়ে হয়তো গঠিত হবে নতুন দেশ, বা বলা ভালো নতুন ইকোনমিক জোন, যেগুলো নিয়ন্ত্রিত হবে এই টেক কোম্পানিগুলো দ্বারা।

ডিস্টোপিয়ান সায়েন্স ফিকশনে যেরকম দেখায়, ধনীরা একটা সুরক্ষিত বলয়ের ভেতরে যান্ত্রিক জীবন যাপন করে, আর তার বাইরে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে বঞ্চিত কিছু উন-মানুষ, হারারি স্পষ্টভাবে না বললেও তার অঙ্কিত চিত্রটা অনেকটা সেরকমই। এবং যেহেতু শুরু থেকেই ফেসবুক, গুগলসহ প্রতিটা টেক জায়ান্টের সাথে ইন্টালিজেন্স এজেন্সিগুলোর গোপন সম্পর্ক আছে, তাই এই নতুন বিশ্বব্যবস্থা যে একইসাথে ডীপ স্টেট দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত হবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এগুলো হতে হতে অবশ্য আরও কয়েক দশক সময় লেগে যাবে। কিন্তু আগামী এক দশকের মধ্যেই কী হবে, সেটা চিন্তা করেন। অথবা অলরেডি কী হয়ে গেছে, সেটা চিন্তা করেন। শুধুমাত্র আপনার জিমেইল, ফেসবুক আর অ্যামাজন অ্যাকাউন্ট দিয়ে আপনি কত শত সার্ভিসের সাথে যুক্ত, সেই কথাটা চিন্তা করেন।

অধিকাংশ সাইটেই যেহেতু এখন জিমেইল বা ফেসবুক দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা যায়, খুব সাবধানী না হলে আপনি নিশ্চয়ই প্রতিটা সাইটে আলাদা আলাদাভাবে রেজিস্ট্রেশন না করে এগুলো দিয়েই করেন। ফলে আজকে যদি কোনো কারণে একইসাথে আপনার এই তিনটা অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দেওয়া হয়, আপনি আবিষ্কার করবেন, আপনার অনলাইন জীবন পুরোপুরি শেষ। ম্যাক্সিমাম সাইটেই আপনি আর লগইন করতে পারছেন না। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন সাইটে তৈরি করা আপনার প্রোফাইল, অনলাইন হিস্টরি, ক্রেডিট, সবকিছু নিমেষেই আপনার হাতছাড়া হয়ে যাবে।

ইন্টারনেটে ছোটখাট স্টার্টআপ বেশি দিন টিকতে পারে না। দ্রুতই গুগল, অ্যামাজন, ফেসবুক বা এরকম জায়ান্টরা তাদেরকে কিনে নেয়। সুতরাং আগামী এক-দেড় দশকের মধ্যে আপনার জীবন যখন খুব বেশি প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে যাবে, তখন আপনি মাত্র দুই-তিনটা টেক জায়ান্টের উপরেই চব্বিশ ঘন্টা পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকবেন।

ঘুম থেকে ডেকে দেওয়ার, রুমের টেম্পারেচার বাড়ানো-কমানোর, লাইট, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেসব “ইন্টারনেট অফ থিংস”-এর কথা আলোচিত হচ্ছে, দেখা যাবে আপনার ঘরে সেগুলো সবগুলোই আছে, এবং সবগুলোই একটা বা দুইটা নির্দিষ্ট কোম্পানির। আপনার ইলেক্ট্রিক কারটাও হয়তো সেই একই কোম্পানির। বিনোদনের জন্য, টাকা-পয়সা লেনদেনের জন্য আপনি যেসব সার্ভিস ব্যবহার করেন, সেগুলোও হয়তো ঐ কোম্পানিগুলোরই। এবং এই সবগুলো সার্ভিস আপনি ব্যবহার করছেন মাত্র একটা বা দুইটা অ্যাকাউন্ট দিয়ে লগইন করেই।

এরকম একটা বিশ্বে আপনি যদি এই টেক জায়ান্টদের, এই নতুন প্রভুদের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করেন, তাদের চোখে যদি আপনি হুমকি হয়ে ওঠেন, এবং তারা যদি আপনার অ্যাকাউন্টগুলো ডিলিট করে দেয়, আপনি আবিষ্কার করবেন, আপনি কিছুই করতে পারছেন না। নিজের স্মার্ট গাড়িতে চড়তে পারছেন না, স্মার্টফোনে লগইন করতে পারছেন না, স্মার্ট টিভি চালাতে পারছেন না, টাকা-পয়সা লেনদেন করতে পারছেন না, এমনকি ঘরের লাইট, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ পর্যন্ত আপনার ভয়েস বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিকগনাইজ করছে না।

সম্পূর্ণরূপে অটোমেশনে চলে যাওয়া এই নতুন পৃথিবীতে আপনি মুহূর্তের মধ্যে পুরোপুরি অপাংক্তেয় হয়ে যাবেন। যেই পৃথিবীতে সবাই নেটিজেন, ইন্টারনেট বিশ্বের নাগরিক, আপনি আবিষ্কার করবেন, সেখানে আপনার কোনো স্থান নাই। আপনি একজন অ-নাগরিক। আপনার সেখানে বেঁচে থাকার কোনো উপায় থাকবে না।

এই সীমাহীন ক্ষমতা টেক কোম্পানিগুলোর হাতে থাকা উচিত না। খুবই সুস্পষ্ট রুল থাকা উচিত, কী কী অপরাধে কারো অ্যাকাউন্ট ডিলিট করা যাবে। টেক কোম্পানিগুলো যেভাবে পুরো বিশ্বে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে, তাতে “মাই কোম্পানি, মাই রুল” নীতি কেবল স্বেচ্ছাচারিতাকেই উস্কে দিবে। এখানে পরিষ্কার একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের ব্যবস্থা থাকা উচিত।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *