আমার প্রথম হ্যাকিংয়ের গল্প: এডওয়ার্ড স্নোডেন

আমার জীবনে প্রথম যে জিনিসটা আমি হ্যাক করেছিলাম, সেটা হচ্ছে সময়। ঘুমোতে যাওয়ার সময়।

আমার কাছে এটাকে খুবই অন্যায্য মনে হতো যে, আমার বাবা-মা নিজেরা কিংবা আমার বোন ঘুমোতে যাওয়ার আগেই আমাকে জোর করে ঘুমোতে পাঠাতেন – আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ার অনেক আগেই। এটা ছিল আমার প্রতি জীবনের প্রথম অবিচার।

আমার জীবনের প্রথম ২,০০০ বা তার কাছাকাছি রাত্রি অতিবাহিত হয়েছিল অবাধ্যতার মধ্য দিয়ে; কান্নাকাটি, অনুনয়-বিনয় আর দর কষাকষির মধ্য দিয়ে। কিন্তু এরপর, ২,১৯৩ তম দিনে, যেদিন আমি ছয় বছর বয়সে পা দিয়েছিলাম, সেদিন রাতে আমি দাবি আদায়ের ডাইরেক্ট অ্যাকশন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলাম। কর্তৃপক্ষ সংস্কারের ডাকে সাড়া দিতে আগ্রহী ছিল না, আর আমিও সদ্যপ্রসূত শিশু ছিলাম না।

সেদিন রাতটা ছিল তখন পর্যন্ত আমার জীবনের সেরা রাতগুলোর মধ্যে একটা। আমার সময় কেটেছিল বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে, জন্মদিনের পার্টি উপভোগ করে, এবং অতিথিদের দেওয়া উপহার গ্রহণ করে! কাজেই কেবলমাত্র সবাইকে বাসায় চলে যেতে হবে – এই অজুহাতে আমি এই আনন্দকে মাটি করতে দিতে রাজি ছিলাম না।

সুতরাং আমি গোপনে এক এক করে বাসার প্রতিটা ঘড়ির সময় কয়েক ঘণ্টা করে পিছিয়ে দিলাম। মাইক্রোওয়েভের ঘড়িটার সময় বদলানো ছিল স্টোভের ঘড়িটার চেয়ে সহজ। কারণ আর কিছুই না, সেটা ছিল আমার নাগালের কাছাকাছি।

কর্তৃপক্ষ যখন তাদের চূড়ান্ত অজ্ঞতার কারণে সময়ের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হলো, তখন আমার আনন্দের কোনো সীমা রইল না। নিজের অসীম ক্ষমতা উপলব্ধি করে আমি পুরো বাড়ির এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ছুটোছুটি করতে লাগলাম। আমার মনে হতে লাগলো, আমি হচ্ছি মাস্টার অফ টাইম। আর কখনোই আমাকে ঘুমোতে পাঠানো হবে না। আমি স্বাধীন।

এবং শেষপর্যন্ত প্রথমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় দিন ২১শে জুনের সূর্যাস্ত দেখার পর ক্লান্ত হয়ে আমি মাটির উপরেই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল, বাসার সবগুলো ঘড়ির সময় ততক্ষণে আবার বাবার হাতঘড়ির সাথে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে।

আজকের দিনে যদি কেউ ঘড়ির সময় মেলাতে চায়, তাহলে তারা কীসের সাথে মেলাবে? আপনি যদি অধিকাংশ মানুষের মতো হন, তাহলে আপনি আপনার স্মার্টফোনের সময়ের সাথেই মেলাবেন। কিন্তু আপনি যদি আপনার ফোনের দিকে তাকান, মানে সত্যিকার অর্থেই গভীরভাবে তাকান, মেনুর ভেতরে গিয়ে সেটিংসে যান, তাহলে দেখতে পাবেন ফোনের সময় আসলে “অটোম্যাটিক্যালি সেট” করা।

নির্দিষ্ট সময় পরপর আপনার ফোন নীরবে, সবার অলক্ষ্যে আপনার সার্ভিস প্রোভাইডারের নেটওয়ার্ককে প্রশ্ন করে, “হেই, তুমি কি সঠিক সময়টা বলতে পার?” সেই নেটওয়ার্ক সঠিক সময়টা জিজ্ঞেস করে আরো বড় একটা নেটওয়ার্ককে, সেটা আবার জিজ্ঞেস করে তার চেয়েও বড় একটা নেটওয়ার্ককে, এবং এভাবে চলতে চলতে শেষপর্যন্ত একের পর এক টাওয়ার আর ওয়্যার পেরিয়ে অনুরোধটা গিয়ে হাজির হয় সত্যিকারের মাস্টার অফ টাইমের কাছে।

এই মাস্টার অফ টাইম হচ্ছে কতগুলো টাইম সার্ভারের একটা নেটওয়ার্ক, যেগুলো সময়ের হিসেব রাখে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রাখা একাধিক অ্যাটমিক ক্লক তথা পারমাণবিক ঘড়ির মাধ্যমে। এই অ্যাটমিক ক্লকগুলো রাখা আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজি, সুইজারল্যান্ডের ফেডেরাল ইনস্টিটিউট অফ মেটিওরোলজি অ্যান্ড ক্লাইমেটোলজি এবং জাপানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স টেকনোলজির মতো স্থানগুলোতে।

স্মার্টফোন থেকে এই স্থানগুলো পর্যন্ত তথ্যের এই সুদীর্ঘ এবং অদৃশ্য ভ্রমণ সংঘটিত হয় এক সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশের মধ্যে। সেজন্যই প্রতিবার আপনার ফোনের ব্যাটারি চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার পর, কিংবা সুইচ বন্ধ করে আবার চালু করার পর আপনি এর সময়কে 12:00টা শুরু হতে দেখেন না।

— এডওয়ার্ড স্নোডেনের আত্মজীবনী “পার্মানেন্ট রেকর্ড” প্রথম কিছু অংশের অনুবাদ। বইটির রিভিউ পড়তে ক্লিক করুন এখানে

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *