ভদ্রমহিলার নাম সালিমা বিনতে মুকাওওয়াস (লিবিয়ান অ্যাকসেন্টে সিলিমা এমগাওয়্যেস)। ঔপনিবেশিক ইতালির বিরুদ্ধে লিবিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কিংবদন্তী নারী যোদ্ধা তিনি।
মুকাওওয়াস সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা যায়, সেগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। তার যুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানা যায় বিদেশী পর্যটক এবং সাংবাদিকদের লেখনী থেকে। অন্যদিকে তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে জানা যায় লিবিয়ান বিভিন্ন পত্রিকা এবং ব্লগ থেকে।
সালিমা বিনতে মুকাওওয়াস ছিলেন লিবিয়ার দক্ষিণের ফেজ্জানের অধিবাসী। সেখানকার নুয়ায়েল গোত্রে তার জন্ম। চার সন্তানের জননী মুকাওওয়াস অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে যান। ১৯১২ সালে যখন ইতালিয়ানরা ত্রিপোলি দখল করে নেয়, তখন জীবিকার তাদিগে তিনি এক ইতালিয়ান সেনাঘাঁটিতে রাঁধুনির সহকারী হিসেবে চাকরি নিতে বাধ্য হন। অবশ্য সেই চাকরিতে কোনো বেতন ছিল না। ইতালিয়ান সেনাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে যা অবশিষ্ট থাকত, সেটাই তিনি নিজের বাচ্চাদের জন্য ঘরে নিয়ে আসতে পারতেন।
ক্যাম্পে তিনি প্রতিনিয়ত অপমান আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতেন। সেখানে ইতালিয়ানদের মুখে লিবিয়ানদেরকে হত্যার, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার বর্ণনা শুনতে শুনতে তার অবচেতন মনে সুপ্ত বিদ্রোহ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। এবং একদিন তিনি অসুস্থ থাকায় কাজ করতে না পারায় যখন এক ইতালিয়ান অফিসার তার গায়ে হাত তোলে, তখন তিনি তার সহ্য ক্ষমতার শেষপ্রান্তে পোঁছে যান। পরদিন তিনি তার বাড়িটা বিক্রি করে দেন, তার চার সন্তানকে ফেজ্জানে তার এক আত্মীয়র বাসায় পাঠিয়ে দেন।
বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে মুকাওওয়াস বাজার থেকে এক ধরনের বিষ কিনে আনেন। সেদিন রান্না করার সময় এক সুযোগে তিনি খাবারের সাথে সেই বিষ মিশিয়ে দেন। ইতালিয়ান সৈন্যরা সেই খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার আগেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান এবং যুদ্ধের ময়দানে মুজাহেদিনদের সাথে গিয়ে যোগ দেন।
সালিমা বিনতে মুকাওওয়াস ত্রিপোলির আশেপাশের প্রায় সবগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার প্রধান ভূমিকা ছিল লম্বা একটা লাঠি হাতে যুদ্ধের ময়দানে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ছোটাছুটি করে, গান গেয়ে এবং কবিতা আবৃত্তি করে যোদ্ধাদেরকে অনুপ্রাণিত করা। এ সময়ই ত্রিপোলি ভ্রমণরত বিভিন্ন ইউরোপীয় পর্যটক এবং সাংবাদিক তার দেখা পান এবং পরবর্তীতে প্রতিবেদনে এবং ভ্রমণ কাহিনীতে তার কথা তুলে ধরেন। তার অংশগ্রহণ করা সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধ ছিল ব্যাটেল অফ গ্যারগ্যারেশ। ফ্রেঞ্চ পত্রিকা লে মার্সেই-এর রিপোর্টার পল ত্রিস্তান এই যুদ্ধে সালিমার বীরত্ব প্রত্যক্ষ করেন এবং যুদ্ধ শেষে মুগ্ধ হয়ে তাকে একটি তলোয়ার উপহার দেন।
ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যালান অস্টলারও তার বইয়ে সালিমা বিনতে মুকাওওয়াসের কথা উল্লেখ করেছেন। তার The Arabs of Tripoli বইয়ে তিনি সালিমাকে জোয়ান অফ আর্কের সাথে তুলনা করেন। গ্যারগ্যারেশ যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করা এই সাংবাদিক বলেন, যুদ্ধের ময়দানে সালিমা তার সাথে থাকা আরো কিছু মহিলাকে সাথে নিয়ে চিৎকার করে বলছিলেন, “কোনো লিবিয়ান যদি যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছু হটে আসে, তাহলে আমরা তার মুখ আমাদের নখ দিয়ে রক্তাক্ত করে দেবো। তার অবস্থান হবে ক্রীতদাসের মতো, তার স্থান হবে বাচ্চাদের তাঁবুতে।”
এই যুদ্ধে একটা উটের পিঠে চড়ে, তার সেই বিখ্যাত লাঠিটা হাতে তিনি যখন সম্মুখভাগে বিচরণ করছিলেন, তখন ইতালিয়ানদের একটা শেলের টুকরা এসে তার বাহুতে আঘাত করে। কিন্তু তারপরেও ফিরে না গিয়ে যোদ্ধাদের সামনে তার সেই রক্তাক্ত হাত নাড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, তারাও যেন এরকম মর্যাদাপূর্ণ আঘাত নিয়ে ফিরে আসে।
তিনি ছিলেন পালিয়ে যাওয়া ইতালিয়ানদের ট্রেঞ্চের ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রথম লিবিয়ানদের মধ্যে একজন। তিনি যখন রক্তে ভেসে যেতে থাকে বাহু নিয়ে ট্রেঞ্চের সামনের নিচু দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন, অ্যালান অস্টলারের ভাষায়, তখন তাকে ঠিক “আফ্রিকান যুদ্ধের দেবী”র মতো দেখাচ্ছিল। এক প্রত্যক্ষদর্শী থেকে অ্যালান বর্ণনা করেছেন, তিনি তার লাঠি দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকা ইতালিয়ানদের দুই-একজনের মাথা ফাটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
যুদ্ধ শেষে তার ভক্তরা যখন তার জন্য বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে আসে, তিনি সেগুলো ফিরিয়ে দেন এবং একটি রাইফেলের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। অবশেষে অটোমান তার্কিশ কমান্ডার নাজিম বে তাকে একটি রাইফেল উপহার দেন। পরবর্তী দিনগুলোতে তিনি চুল কেটে, পুরুষদের মতো পোশাক করে, ঘোড়ায় চড়ে এই রাইফেল হাতে আরো কিছু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
সালিমা বিনতে মুকাওওয়াসের পরবর্তী জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি একাধিকবার আহত হয়েছিলেন। একবার বুকে আঘাত পাওয়ার পরেও দুই সপ্তাহ বিশ্রাম নিয়ে তিনি আবারও যুদ্ধের ময়দানে ছুটে গিয়েছিলেন। শোনা যায় এরকমই কোনো এক যুদ্ধে ইতালিয়ানদের কামানের গোলায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: লিবিয়া অবজার্ভার, আখবারাক ডট নেট, এখুয়ান উইকি, The Arabs of Tripoli
লিবিয়া বিষয়ক আমার সবগুলো লেখা একত্রে পেতে ক্লিক করুন এখানে।
তাকে ও তার অসম্ভবসুন্দর বীরত্বকে বেশী করে প্রমোটার করা উচিত । অসংখ্য ধন্যবাদ আপনানাকে