Views:
453
গ্রীক পরিচালক কোস্তা গাভরাস (Costa-Gavras) এর মুভি প্রথমে দেখেছিলাম ২০১০ সালের দিকে, মিসিং (Missing)। চিলির সামরিক অভ্যুত্থান, গণহত্যা এবং সেই অভ্যুত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন ভূমিকার উপর সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত অসাধারণ একটা পলিটিক্যাল থ্রিলার।
এরপর আইএমডিবিতে (IMDB – Internet Movie Database) গিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারলাম, এই পরিচালকের সবচেয়ে বেশি রেটিং পাওয়া মুভি হচ্ছে আরেকটা পলিটিক্যাল থ্রিলার, Z (1969)। আইএমডিবি রেটিং 8.2, কিন্তু ফ্রেঞ্চ ভাষায় নির্মিত সিনেমাটার ভোটসংখ্যা কম হওয়ায় আইএমডিবির অ্যালগরিদম অনুযায়ী এটা টপ লিস্টে উঠতে পারেনি।
কোস্তা গাভরাসের পলিটিক্যাল থ্রিলার মুভি জেড এর একটা বিকল্প পোস্টার
পলিটিক্যাল থ্রিলার সব সময়ই আমার ফেভারিট জঁনরা। দেরি না করে সাথে সাথেই খোঁজা শুরু করে দিলাম। কিন্তু অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য এই মুভিটা মিডিয়াফায়ারে তো পেলামই না, টরেন্টেও ৭০০ মেগার যেই লিংকটা পেলাম, সেটার সীড একেবারেই কম। কাজেই ডাউনলোড করা হলো না।
২০১১ সালের লিবিয়া যুদ্ধে গাদ্দাফীর সরকার দীর্ঘ আট মাস পর্যন্ত ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখেছিল। গাদ্দাফীর পতনের পর বিদ্রোহীরা ক্ষমতায় এসে যখন ইন্টারনেট উন্মুক্ত করে দিলো, তখন আবার নতুন করে সার্চ দিলাম। এবার পেয়ে গেলাম বেশ ভালো সীড সহ একটা লিংক, সাইজ প্রায় দেড় গিগা।
বিদ্রোহীরা ক্ষমতায় আসার পর ত্রিপলীতে প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত ওয়াইম্যাক্স কানেকশন ফ্রি এবং আনলিমিটেড রাখার পর আবার লিমিটেশন বসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সিরতে তখনও পর্যন্ত এডিএসএল (ADSL) কানেকশন সম্পূর্ণ ফ্রি এবং আনলিমিটেড ছিল। কাজেই সাইজের চিন্তা না করে ঝটপট ডাউনলোড করে ফেললাম।
আমার সবগুলো মুভি রিভিউ একত্রে পেতে চাইলে ভিজিট করুন এই পাতা। রিভিউ ছাড়াও এখানে আছে বিভিন্ন মুভি এবং সিরিয়ালের পেছনের কাহিনীসহ নানাবিধ আলোচনা।
মুভিটা দেখতে বসে একেবারে প্রথমেই একটু নড়ে চড়ে বসতে হল। কারণ সাধারণত অধিকাংশ মুভির শুরুতে লেখা থাকে, এর সব চরিত্র কাল্পনিক, কারো সাথে মিলে গিলে তা নিছক কাকতালীয়। কিন্তু এই প্রথম একটা মুভি দেখলাম যার শুরুতে একেবারে বড় হাতের অক্ষরে লেখা, কারো সাথে মিলে গেলে সেটা INTENTIONAL, অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত। বুঝে গেলাম ঠিক এই রকম একটা মুভিই খুঁজছিলাম এতোদিন।
কোস্তা গাভরাসের পরিচালনার স্টাইল একেবারেই সিম্পল, ডকুমেন্টারি টাইপের। তার এই মুভিটাও পলিটিক্যাল থ্রিলার এর মোড়কে মূলত একটা ডকু ড্রামা। কিন্তু তার মুভির সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে, তার কাহিনীগুলো অসাধারণ। জেড সিনেমাটাতেও তা-ই। প্রথম বিশ-পঁচিশ মিনিট খুব একটা আহামরি মনে না হলেও কাহিনী যত এগোতে থাকে, ততই স্ক্রিন থেকে চোখ সরানো কঠিন হয়ে পড়ে।
মুভির কাহিনী গ্রীসের সরকার কর্তৃক এক রাজনীতিবিদের হত্যা এবং তার পরবর্তী তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে। ফ্যাসিবাদী সরকারের অস্ত্র এবং পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে ঐ জনপ্রিয় নেতার রাজনৈতিক দল র্যালির আয়োজন করলে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাতে বিভিন্নভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে তারা র্যালি আয়োজনকারী গণতন্ত্রপন্থী জনপ্রিয় ঐ নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ প্রধানের আয়োজনে এবং পুলিশ বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, সরকারি গোপন সংগঠনের সদস্যদের লেলিয়ে দিয়ে সেই নেতাকে মিছিলের মধ্যে হত্যা করা হয়। পুলিশ রিপোর্টে এবং সরকারি মিডিয়াগুলোতে এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয় এবং মিছিলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য বিরোধী দলের র্যালি আয়োজনকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হতে থাকলে ঘটনা তদন্তের জন্য সরকার একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়।
তদন্তে একের পর এক গোপন ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেতে থাকে। এক সাংবাদিকের সহায়তায় ম্যাজিস্ট্রেটের সাহসী তদন্তে সত্য বেরিয়ে আসতে থাকে। পুলিশের পক্ষ থেকে তো বটেই, এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং মন্ত্রীর পক্ষ থেকেও পুলিশ এবং সরকারকে বাঁচানোর জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু সৎ এবং সাহসী ম্যাজিস্ট্রেট শেষপর্যন্ত তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং পুলিশ প্রধানসহ ঘটনার সাথে জড়িত সবাইকে হত্যা এবং হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।
কিন্তু এতো কিছু করেও শেষ রক্ষা হয় না। নোংরা রাজনীতির আড়ালে হারিয়ে যায় সকল প্রচেষ্টা। সরকারকে যদিও পদত্যাগ করতে হয়, কিন্তু ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। বিভিন্ন সাক্ষীরা এবং বিরোধীদলের নেতারা রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করতে থাকে। হত্যাকারীদের স্বল্প সাজা হয়, সরকারি কর্মকর্তারা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়, এবং সর্বোপরি নিষিদ্ধ হয় সকল গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড।
সিনেমার একেবারে শেষে সেনাবাহিনী কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত কর্মকাণ্ডের একটা তালিকা দেখানো হয়। সেই তালিকায় আছে লম্বা চুল, মিনি স্কার্ট, রাশিয়ান টোস্ট, স্বাধীন সংবাদপত্র, টলস্টয়, দস্তভয়স্কি, মিছিল-মিটিং, আধুনিক গণিত এবং ইংরেজি বর্ণ “Z”! কারণ প্রাচীন গ্রীক ভাষায় Z তথা Zi এর অর্থ হলো, তিনি বেঁচে আছেন। খুন হওয়া নেতার সমর্থকরা তাদের নেতার অমরত্বকে এই Z দ্বারাই প্রকাশ করত। সিনেমাটার নামও তাই এই Z। উল্লেখ্য, এই সিনেমা এবং জার্মান সিনেমা M পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ছোটো নামের মুভি।
অসাধারণ এই পলিটিক্যাল থ্রিলারটার বিভিন্ন ঘটনা এবং দৃশ্য দেখতে গিয়ে বারবার বাংলাদেশের রাজনীতির কথাই মনে পড়ে। সবচেয়ে হতাশ লাগে, গ্রীসে তবুও একজন সত্ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, যিনি সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেও সুষ্ঠুভাবে তদন্ত শেষ করে সত্যিকার দোষীদেরকে সাব্যস্ত করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশে কি সেরকম কেউ আছে? যদি থাকে তাহলে কেন আমাদের তদন্ত রিপোর্টগুলো প্রকাশিত হয় না? কেন কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় না, দোষীদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না?
কোস্তা গাভরাস যখন এই মুভিটা বানিয়েছেন, তখনও গ্রীসে সামরিক শাসন। নিজ দেশে বানানো সম্ভব না, তাই তিনি এটা বানিয়েছেন আলজেরিয়ায়। মুভির প্রযোজকও আলজেরিয়ান। আর তাই এটা শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে যে অস্কার পেয়েছে, সেটাকে আলজেরিয়ার প্রথম অস্কার হিসেবে ধরা হয়। এই মুভিটাই প্রথম মুভি, যেটা একই সাথে বেস্ট পিকচার এবং বেস্ট পিকচার ইন ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ক্যাটাগরিতে অস্কার নমিনেশন পেয়েছিল।
কোস্তা গাভরাসকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি কেন এই মুভিটা বানিয়েছেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, প্রথমত, আমি একজন গ্রীক। আর দ্বিতীয়ত, মানুষ অনেক কিছু করে। কেউ মিছিলে যায়, কেউ পিটিশনে সাইন করে, আমি না হয় ফিল্মই বানালাম! দুঃখের বিষয়, আমাদের পরিচালকরা এই বিষয়টা বুঝল না!