গার্দাবিয়া যুদ্ধের ইতিহাস: লিবিয়াতে ইতালিয়ান শাসন সমাপ্তির সূচনা

১৯১১ সালে ঔপনিবেশিক ইতালীয়রা লিবিয়া আক্রমণ করে। সে সময় লিবিয়া ছিল ক্ষয়িষ্ণু অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ কয়েকটি প্রদেশের সমষ্টি। অটোমানরা প্রথম দিকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কামাল আতাতুর্ক সে সময় লিবিয়াতে অটোমান বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত ছিল। তার নেতৃত্বে তবরুক এবং দারনায় অটোমান বাহিনী বেশ কিছু যুদ্ধে জয়লাভও করে।

কিন্তু তুরস্কের নিজের অবস্থাই তখন সুবিধার না। ফলে লিবিয়ার মতো কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকার পেছনে সামরিক শক্তি ক্ষয় করার পক্ষপাতী তারা ছিল না। ইতালিয়ানদের কাছ থেকে লিবিয়া রক্ষা করার চেয়ে ব্রিটিশদের হাত থেকে মিসর রক্ষা করা তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে মাত্র এক বছর যুদ্ধ করার পরই ১৯১২ সালে অটোমানরা ইতালির সাথে শান্তিচুক্তি করে। তারা রোডস দ্বীপের বিনিময়ে লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ ইতালির হাতে ছেড়ে দেয় এবং লিবিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।

অটোমানরা লিবিয়া ছেড়ে দিলেও হাল ছাড়েনি সেনুসি মুজাহেদিনরা। তাদের নেতৃত্বে লিবিয়ান স্বেচ্ছাসেবীরা প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ইতালিয়ানদের উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের কাছে তারা পরাজিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে প্রায় সমগ্র উপকূলীয় এলাকা, এবং সাহারার কিছু এলাকাও ইতালিয়ানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কিন্তু তারপরেও সেনুসিরা সংগঠিত হতে থাকে এবং ইতালিয়ানদের উপর চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

১৯১৫ সালের ২৯ এপ্রিল সিরতের ক্বাসর আবুহাদি (আল-ক্বারদাবিয়া বা গার্দাবিয়া) এলাকায় ইতালিয়ান বাহিনীর ছয় সহস্রাধিক সৈন্যের মুখোমুখি হয় লিবিয়ানরা। শুরু হয় বিশাল যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ডিসাইসিভ ভূমিকা পালন করে মিসরাতার রমাদান আস্‌-সোয়েহ্‌লি (মিসরাতান পলিটিশিয়ান আব্দুর রহমান সোয়েহ্‌লির দাদা)।

রমাদান সোয়েহ্‌লি প্রথমে অটোমানদের পক্ষ হয়ে ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও অটোমানরা ইতালির সাথে শান্তিচুক্তি করার পর সে ইতালিয়ান বাহিনীর পক্ষে কাজ করতে শুরু করে। গার্দাবিয়ার যুদ্ধেও শুরুতে তার নেতৃত্বাধীন ৩,০০০ সৈন্য ছিল ইতালিয়ানদের পক্ষে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পরপরই সুযোগ বুঝে সে তার বাহিনীকে পাল্টা ইতালিয়ানদের উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দেয়।

যুদ্ধে ইতালিয়ানদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তাদের পাঁচ শতাধিক সৈন্য নিহত হয়, যাদের মধ্যে ১৯ জন ছিল অফিসার। নিহতদের প্রায় অর্ধেক ছিল ইথিওপিয়ান আস্‌কারি, যাদেরকে ইতালিয়ানদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল। পরাজিত হয়ে ইতালিয়ান বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যেতে থাকে। তাদের ফেলে যাওয়া প্রায় ৫,০০০ রাইফেল, কয়েক মিলিয়ন বুলেট, বেশ কিছু কামান এবং মেশিনগান লিবিয়ানদের হাতে চলে আসে।

‘মা’আরাকাত আল-ক্বার্‌দাবিয়া’ তথা ‘ব্যাটল অফ ক্বার্‌দাবিয়া’ বা ‘ব্যাটল অফ ক্বাসর আবু হাদি’ নামে পরিচিত এই যুদ্ধ ছিল ১৮৯৬ সালে ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর থেকে ইতালিয়ানদের সবচেয়ে বড় পরাজয়। আর লিবিয়াতে এই যুদ্ধ ছিল ইতালিয়ানদের জন্য বিগিনিং অফ দ্য এন্ড।

এই পরাজয়ের ধারাবাহিকতায় ইতালিয়ানরা একের পর এক এলাকা হারাতে থাকে। মাত্র এক মাসের মধ্যেই লিবিয়ানরা সিরত থেকে মিসরাতা হয়ে ত্রিপোলির ক্বাসর বেনগাশির পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এ সময়ের মধ্যে লিবিয়ানদের হাতে কয়েক হাজার ইতালিয়ান সৈন্য নিহত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে মুসোলিনির উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত ইতালিয়ানরা লিবিয়াতে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

গার্দাবিয়ার যুদ্ধের সেই সব বীর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সিরতের নিকটে গার্দাবিয়ায় নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ, যা বৃহত্তর সিরতের অন্যতম প্রধান ল্যান্ডমার্ক। এই স্মৃতিসৌধের পেছনেই আছে যুদ্ধে শহীদদের কবরস্থান। ভবনটির ভেতরে এক সময় জাদুঘর ছিল। বর্তমানে অবশ্য এটা পরিত্যক্ত।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

One comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *