এক কবির কাছে খলিফা আল-মানসুর যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন

আবু জাফর আল-মানসুর ছিলেন দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা, যিনি প্রধানত খলিফা আল-মানসুর নামেই পরিচিত। কথিত আছে, তিনি কবিদের উপর বেশ ক্ষিপ্ত ছিলেন। কারণ তার মতে কবিরা যেভাবে শুধু কয়েক লাইন কবিতা শুনিয়ে শাসকদেরকে খুশি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করে নিত, তার দৃষ্টিতে তা ছিল পুরো ডাকাতি।

তো কবিদেরকে জব্দ করার জন্য তিনি এক অভিনব নিয়ম চালু করেছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, কোনো কবির কবিতা যদি সম্পূর্ণ নতুন না হয়, তাহলে তিনি তাকে এক পয়সাও দিবেন না, উল্টো রাজদরবারে তার কবিতা আবৃত্তি করার অধিকার রহিত করে দিবেন। কিন্তু যদি কেউ সম্পূর্ণ নতুন কবিতা শোনাতে পারে, তাহলে কবিতাটার ওজনের সমমূল্যের স্বর্ণমুদ্রা তাকে উপহার দিবেন।

খুব সহজ শর্ত মনে হচ্ছে? মোটেই না। কারণ আল-মানসুর ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। যেকোনো কবিতা তিনি একবার শুনেই হুবহু মুখস্ত বলে দিতে পারতেন। ফলে যে কবিই তাকে নতুন লেখা কবিতা শোনাতে আসত, একবার শোনার পরেই তিনি বলতেন – এই কবিতা তো আমি আগেই শুনেছি! এই যে দেখ, এটা আমার হুবহু মুখস্ত আছে!

আরো পড়ুন: কর্দোভার খ্রিস্টান শহিদরা: ডঃ ইয়াসির ক্বাদি

শুধু তা-ই না, খলিফা আল-মানসুরের দুজন দাস-দাসী ছিল, যাদের স্মৃতিশক্তিও ছিল অসাধারণ। দাস বালকটি যেকোনো কবিতা দুইবার শুনে মুখস্ত বলে দিতে পারত, আর দাসী বালিকাটি তিনবার শুনে মুখস্ত বলে দিতে পারত। তো প্রথমবার কবির মুখ থেকে এবং দ্বিতীয়বার খলিফার মুখ থেকে শোনার পর যখন দাস বালকটারও কবিতা মুখস্ত হয়ে যেত, তখন খলিফা কবিকে বলতেন – তোমার এই কবিতা শুধু আমি না, আমার দাসও আগে শুনেছে। এই দেখ এটা তারও মুখস্ত।

একইভাবে দাসী বালিকাটিও তৃতীয়বার শোনার পর তা মুখস্ত বলে দিয়ে কবিদেরকে হতবাক করে দিত। পুরস্কারের আশা বাদ দিয়ে কবিদেরকে তখন খালি হাতে ফিরে যেতে হতো। পরিস্থিতি শেষপর্যন্ত এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, কবিরা কাব্যচর্চায়ই আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে বসেছিল!

আরো পড়ুন: ড্যানিশ লরেন্স অফ অ্যারাবিয়ার ইসলাম গ্রহণ এবং লিবিয়া ভ্রমণের গল্প

এ অবস্থায় কবিদেরকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে এলেন আল-আসমাঈ নামের একজন প্রতিভাবান কবি। তিনি এমন এক কবিতা রচনা করলেন, যার শব্দের গাঁথুনি এতো চমৎকার, কিন্তু একইসাথে এতো জটিল যে, খলিফার পক্ষে সেটা একবার শুনে আর মুখস্ত বলা সম্ভব হলো না।

বাধ্য হয়ে খলিফা আল-মানসুর তাকে পুরস্কার দিতে রাজি হলেন। তিনি কবিকে বললেন, যে কাগজ বা চামড়ার উপর কবিতাটি লেখা হয়েছে, সেটা তার কর্মচারীদেরকে দেওয়ার জন্য, যেন তারা সেটা ওজন করে তার সমপরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করতে পারে।

কিন্তু আসমাঈ ছিলেন খলিফার চেয়েও কৌশলী। তিনি জানালেন, খলিফার শর্তের কোথাও বলা ছিল না যে, কাগজ বা চামড়ার উপরেই কবিতা লিখতে হবে। কাজেই তিনি তার কবিতাটি লিখেছেন মার্বেলের একটা স্ল্যাবের উপর, যেটা বহন করে এনেছে ১০ জন ভৃত্য (ভিন্ন বর্ণনায় ৪টি উট)!

খলিফার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কারণ মার্বেলের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা দিতে গেলে বাইতুল মাল ফাঁকা হয়ে যাবে। তিনি আসমাঈকে অনুরোধ করলেন বিষয়টা পুনর্বিবেচনার জন্য। আসমাঈ তখন জানালেন, তিনি তার দাবি ছেড়ে দিতে রাজি আছেন, কিন্তু খলিফাকেও কথা দিতে হবে, তিনি এখন থেকে কবিদেরকে তাদের যোগ্য সম্মান এবং পুরস্কার প্রদান করবেন।

খলিফা আল-মানসুর কথা দিলেন এবং আসমাঈও তার দাবি ছেড়ে দিলেন।

যে কবিতাটি আসমাঈ লিখেছিলেন, তার নাম “সাউতু সাফির আল-বুলবুলি” তথা বুলবুল পাখির কণ্ঠ/গান। অর্থ বোঝার কোনো দরকার নাই। জাস্ট লিঙ্কে গিয়ে কবিতাটার আবৃত্তি শুনে দেখেন। অসাধারণ ছন্দ, অসাধারণ শব্দের গাঁথুনি!

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

3 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *