লিবিয়াতে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করেছে রাশিয়া!

গত মাসে লিবিয়াতে পরপর দুইটা ড্রোন ভূপাতিত হয়েছিল। একটা ইতালিয়ান, আরেকটা আমেরিকান। দুইটাই ভূপাতিত করা হয়েছিল ত্রিপোলির হাফতার নিয়ন্ত্রিত এলাকার আকাশে, হাফতারবাহিনী অথবা তাদের মিত্রদের দ্বারা। এবং আজ আমেরিকা দাবি করেছে, তাদের ড্রোনটা ভূপাতিত করেছে হাফতার নিয়োজিত রাশিয়ান মিলিটারি কনট্রাক্টররা!

লিবিয়ার আকাশে বিদেশী প্লেনের উপস্থিতি নতুন কিছু না। ২০১১ সালের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটো লিবিয়া থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তাদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সম্ভবত কখনোই ফেরত যায়নি।

যুদ্ধের কারণে শহরের ঘরবাড়ির পাশাপাশি বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। প্রথম বৈদ্যুতিক আলোর দেখা পেতে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় চার-পাঁচ মাস। অফুরন্ত অবসরের সেই অন্ধকার দিনগুলোতে রাতের বেলা আমরা যখন বাসার বাইরে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকতাম, তখনই কেবল আমাদের চোখে ধরা দিত আমাদের পৃথিবীর একমাত্র কৃত্রিম বাতির উৎস – চাঁদ আর তারার আলোর ফাঁকে ফাঁকে মৃদু গুঞ্জনে উড়তে থাকা ভিনদেশী প্লেনগুলোর মিটমিট আলো।

লিবিয়ার আকাশে বিদেশীদের এই ওড়া-উড়ি কখনোই বন্ধ হয়নি। ২০১২ সালের পর ঠিক কারা কারা ছিল, বলা মুশকিল। কিন্তু ২০১৪ সালে নতুন করে গৃহযুদ্ধ এবং ২০১৫/২০১৬ সালে আইএসবিরোধী শুরু হওয়ার পর আমেরিকা ছাড়াও ব্রিটেন, ফ্রান্স, মিসর, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশের প্লেনগুলো নতুন করে লিবিয়াতে ইনভলভড হতে শুরু করে।

গত মাসে ইতালিয়ান ড্রোন ভূপাতিত করার পর হাফতারবাহিনীর পক্ষ থেকে ইতালিয়ানদের উপস্থিতি নিয়ে বেশ শোরগোল তোলা হয়েছিল। কিন্তু সেই তুলনায় আমেরিকান ড্রোনের উপস্থিতি নিয়ে তারা নীরব ছিল। কারণ লিবিয়ার আকাশে আমেরিকানদের উপস্থিতি আইনগতভাবে বৈধ। তারা এখানে আছে আইএসবিরোধী যুদ্ধের কনটেক্সটে।

আমেরিকানরা অবশ্য আইএসবিরোধী যুদ্ধে কোর্ডিনেট করছে মূলত হাফতারের প্রতিপক্ষবাহিনী, জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের সাথে। কিন্তু তারপরেও হাফতার তাদের বিরুদ্ধে নীরব দুইটা কারণে। প্রথমত, আমেরিকানরা আসলেই লিবিয়াতে আইএস নির্মূলে জেনুইন ভূমিকা পালন করেছিল এবং এখনও করে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, হাফতার আসলে আমেরিকানদেরকে ঘাঁটাতে চায় না। যদিও আমেরিকা সরাসরি হাফতারকে সাপোর্ট করছে না, কিন্তু হাফতার যদি ত্রিপোলি দখল করে ফেলতে পারে, তাহলে আমেরিকা ঠিকই তাকে মেনে নিবে। এই সম্ভাবনা হাফতার নষ্ট করতে চায় না।

লিবিয়াতে এই মুহূর্তে যে যুদ্ধটা চলছে, সেটা মূলত একটা আন্তর্জাতিক প্রক্সিযুদ্ধ। এ সম্পর্কে প্রথম আলোয় প্রকাশিত আমার একটা লেখা পড়তে পারেন এখান থেকে, এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বণিক বার্তায় প্রকাশিত আমার একটা লেখা পড়তে পারেন এখান থেকে, আর ২০১১ সাল থেকে লিবিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি উপনীত হওয়ার ইতিহাস সম্পর্কে বিডিনিউজ ২৪ ডট কমে প্রকাশিত একটা লেখা পড়তে পারেন এখান থেকে

কিন্তু মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করার ব্যাপারটা এখন হাফতারকে একটু বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর আফ্রিকা কমান্ডের (আফ্রিকম) প্রধান জেনারেল স্টিফেন টাউনসেন্ডের বরাত দিয়ে রয়টার্স দাবি করছে, আফ্রিকমের বিশ্বাস হাফতারের পক্ষে যে রাশিয়ান মিলিটারি কনট্রাক্টররা (ওয়াগনার গ্রুপ) কাজ করছে, তারাই মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করেছে।

তবে রয়টার্স এটাও উল্লেখ করেছে, টাউনসেন্ড বিশ্বাস করেন, রাশিয়ানরা ইচ্ছা করে এই কাজ করেনি। তারা বুঝতে পারেনি এটা মার্কিন ড্রোন। তারা হয়তো জিএনএর পক্ষের (তার্কিশ) ড্রোন মনে করেই এটা ভূপাতিত করেছিল। কিন্তু এখন যেহেতু তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের উচিত সেটা স্বীকার করা এবং ধ্বংসাবশেষ ফেরত দেওয়া।

হাফতারের প্রতিপক্ষবাহিনী, ত্রিপোলির জাতিসংঘ সমর্থিত জিএনএ (গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড) সরকারের এক কর্মকর্তাও একই মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি দাবি করেন, হাফতারের মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করার মতো সামর্থ্য নাই। ওটা একমাত্র রাশিয়ানদের দ্বারাই সম্ভব।

তিনি আরও দাবি করেন, তাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী হাফতারের সেই সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ানরা তাকে চাপ দিয়েছিল মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করার দায় স্বীকার করে নেওয়ার জন্য। যদিও এখনও পর্যন্ত কেউই দায় স্বীকার করেনি।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *