ইসরায়েলের গোপন অপারেশনগুলো: প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ

১৯৪৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। জেরুজালেমের রুমানিয়ান চার্চের ব্রিটিশ ম্যাণ্ডেটের প্রশাসনিক ভবন থেকে বেরিয়ে এলেন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেণ্টের (সিআইডি) বিশেষ ইহুদী বিভাগের কমাণ্ডার, টম উইলকিন। তার গন্তব্য ছিল সিআইডির নিকটবর্তী রাশিয়ান কম্পাউণ্ড, যেখানে ইহুদী গুপ্ত সংস্থাগুলোর সদস্যদেরকে আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো।

অন্য সব সময়ের মতো সেদিনও উইলকিন সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করছিলেন। রাস্তা পার হওয়ার আগেই তিনি উঁকি মেরে দেখে নিয়েছিলেন রাস্তার দু’পাশ, এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে স্পর্শ করে রেখেছিলেন তার রিভলভারটি। কিন্তু তার জানার কথা ছিল না, একটু সামনের সেইন্ট জর্জ স্ট্রিটের এক অন্ধকার সরু গলির ভেতর তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওঁৎ পেতে ছিল কুখ্যাত ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠন ‘লেহি‘র এক সদস্য, ডেভিড শমরন।

লেহির অপারেশন বিভাগের প্রধান ইতজাক শামিরের নির্দেশে ডেভিড শমরন এবং ইয়াকভ বানাই টম উইলকিনের উপর হামলার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছিলেন। জেরুজালেমের রুমানিয়ান চার্চের বাসভবনে উইলকিনের অবস্থান নিশ্চিত করার পর তারা তাদের অভিযান শুরু করেন।

শমরন এবং বানাই অবস্থান নেন সেইন্ট জর্জ স্ট্রিটের এক অন্ধকার সরু গলির ভেতর। তাদের পকেটে ছিল রিভলভার এবং গ্রেনেড। রাস্তার অপর পাশে মুদির দোকার সামনে এবং অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান নেয় লেহির অন্যান্য এজেন্টরা। তাদের পরনে ছিল পরিচ্ছন্ন স্যুট এবং হ্যাট, যেন তাদেরকে ব্রিটিশ বলে মনে হয়।

স্টার্ন গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ পুলিশের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, মাঝে ইৎজাক শামির; Source: Wikimedia Commons

টম উইলকিন যখন রাশিয়ান কম্পাউণ্ডে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সেইন্ট জর্জ স্ট্রিটে এসে পৌঁছেন, তখন মুদির দোকানের সামনে অবস্থান নেওয়া লেহির এক এজেন্ট উঠে দাঁড়ায় এবং তার হ্যাটটি মাটিতে ফেলে আবার কুড়িয়ে নেয়। এটি ছিল শমরন এবং বানাইয়ের প্রতি তার বিশেষ সিগনাল। তারা গলি থেকে বের হয়ে উইলকিনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।

প্রথমে তারা উইলকিনকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে যান। পকেট থেকে তাদেরকে সরবরাহ করা উইলকিনের ছবি বের করে আবারও নিশ্চিত হয়ে নেন তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে। এরপর ঘুরে উল্টোদিকে হেঁটে আসতে থাকেন। পকেটে শক্ত হাতে ধরে রাখেন তাদের রিভলভার এবং গ্রেনেড।

অপারেশনের আগে বানাই শমরনকে অনুরোধ করেছিলেন যে, তিনিই প্রথমে উইলকিনকে গুলি করবেন। কিন্তু কাছাকাছি যাওয়ার পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি শমরন। পকেট থেকে রিভলভার বের করে গুলি করতে শুরু করেন। দুজনেই পুরো ম্যাগাজিন শেষ করে ফেলেন উইলকিনের উপর। তাদের ১৪টি গুলির মধ্যে ১১টিই আঘাত করে উইলকিনের শরীরে। উইলকিন ঘুরে দাঁড়ান, পকেট থেকে তার রিভলভারটিও বের করেন, কিন্তু ততক্ষণে তার শরীরে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে যান তিনি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে তার।

বহু বছর পরে এক সাক্ষাৎকারে শমরন স্বীকার করেছিলেন, উইলকিন হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। তারা বিশ্বাস করতেন, যত বেশি ব্রিটিশ অফিসারের লাশবাহী কফিন ব্রিটেনে ফেরত যাবে, তাদের ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যও তত দ্রুত অর্জিত হবে। তার শুধু একটাই আফসোস, সেদিন উইলকিনকে হত্যার পর তাড়াহুড়া করে পালাতে গিয়ে তারা তার সাথে থাকা ব্রিফকেসটা নিয়ে যেতে পারেননি। সেটা নিতে পারলে হয়তো তারা ব্রিটিশ গোয়েন্দাবাহিনীর অনেক গোপন তথ্য জানতে পারতেন, যা তাদের পরবর্তী অপারেশনগুলোতে কাজে আসত।

এই সিরিজের মতোই অন্যান্য বই থেকে আমার লেখা অনুবাদ বা রূপান্তরগুলো একসাথে পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এই পাতায়। এই পাতায় একইসাথে পাবেন আমার লেখা বিভিন্ন বইয়ের রিভিউও।

ব্রিটিশ অফিসার টম উইলকিনকে হত্যা লেহির একমাত্র অপারেশন ছিল না, বা লেহিও ইহুদীদের একমাত্র বা প্রথম গুপ্ত সংগঠন ছিল না। লেহির এবং অন্যান্য সংগঠনের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়েছে আমার লেখা এই সিরিজে। এটা হচ্ছে সিরিজের প্রথম পর্বের একটা অংশ মাত্র। সিরিজটা সম্পূর্ণ করা হয়নি, মোট ১২টি পর্ব আছে, কিন্তু এই পর্বগুলোতেই ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকের অনেকগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিবরণ উঠে এসেছে।

সিরিজটা উপস্থাপনার প্রয়োজনে বিভিন্ন উৎসের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। তবে প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত ইসরায়েলি গবেষক ও ইতিহাসবিদ রোনান বার্গম্যানের বই Rise and Kill Fisrt: The Secret History of Israel’s Targeted Assassinations বইটিযে বইটিতে উঠে এসেছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন অজানা অপারেশনের কাহিনী।

বইটির একটি অধ্যায় অবলম্বনে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাতকে হত্যার লক্ষ্যে সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের অনেকগুলো অপারেশনের বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত একটি লেখা পড়তে পারেন এই লিংক থেকে

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

2 Comments

  1. ইসরায়েল রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিষ্ঠিতই হয়েছে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে। এই সন্ত্রাসবাদী দেশ এখন নিজেদের সামরিক শক্তি, বুদ্ধিমত্তা আর ব্যাকআপের সহযোগিতায় তাদের সব কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়ে আসছে। মাঝখান দিয়ে প্যালেস্টাইন হয়ে গেল এতিম রাষ্ট্র।

  2. ধন্যবাদ স্যার, এত সহজবোধ্যভাবে রেফারেনসসহ ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন আপনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *