প্রিন্সেস সারভাত: যে বাঙালি নারী হতে যাচ্ছিলেন জর্ডানের রানি!

তার নাম প্রিন্সেস সারভাত (সারওয়াত) একরামউল্লাহ। জন্ম কলকাতায়। তার বাবা ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব, আর মা ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম দুই নারী এমপির একজন।

কিন্তু তার আরও দুটি পরিচয়ও আছে। তিনি হচ্ছেন পাকিস্তানের এককালের প্রধানমন্ত্রী, এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর ভাগ্নি। তার মা ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর মামাতো বোন। একইসাথে তিনি বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের শ্যালিকা। এবং এই সারভাতেরই হওয়ার কথা ছিল জর্ডানের রানি!

সারভাতের বিয়ে হয়েছিল জর্ডানের ক্রাউন প্রিন্স হাসান বিন তালালের সাথে। সে সময় ক্ষমতায় ছিলেন হাসানের বড় ভাই, বাদশাহ হুসেইন বিন তালাল। এবং হুসেইনের মৃত্যু হলে হাসানেরই রাজা হওয়ার কথা ছিল।

নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে অবশ্য ক্রাউন প্রিন্স ছিলেন হুসেইনের বড় ছেলে আব্দুল্লাহ। কিন্তু আব্দুল্লাহর মা, রানি মুনা ছিলেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত। সে হিসেবে আব্দুল্লাহ ছিলেন হাফ ব্রিটিশ। ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে বাদশাহ হুসেইনের বিরুদ্ধে যখন নানান ধরনের ষড়যন্ত্র চলছিল, তখন তিনি বিতর্ক এড়ানোর জন্য এবং পুত্রের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তার পরিবর্তে ভাই হাসানকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মনোনীত করেন।

১৯৬৮ সালে ক্রাউন প্রিন্স হাসান বিয়ে করেন সারভাত একরামউল্লাহকে। ফলে বাঙালি নারী সারভাত হয়ে যান জর্ডানের ক্রাউন প্রিন্সেস – সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রানি। পরবর্তী ৩০ বছর তিনি এই পদে বহাল থাকেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে, মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে হাসপাতালের বিছানায় শোয়া বাদশাহ হুসেইন হঠাৎ তার ভাইয়ের মনোনয়ন বাতিল করে নিজের বড় ছেলে আব্দুল্লাহকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মনোনীত করেন। সারভাতের রানি হওয়ার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়।

প্রিন্সেস সারভাত হাসান-এর বিভিন্ন সময়ের ছবি। ফুল রেজোল্যুশন এখানে

শোনা যায়, হুসেইনের এই সিদ্ধান্তের পেছনে তার আরেক স্ত্রী, রানি নূরের ভূমিকা ছিল। নূরের সাথে সারভাতের বেশ দ্বন্দ্ব ছিল। নূর, আব্দুল্লাহ এবং হুসেইনকে প্ররোচিত করেন আব্দুল্লাহকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দিতে। বিনিময়ে তার চাওয়া ছিল আব্দুল্লাহ সিংহাসনে বসলে তার নিজের ছেলেকে ক্রাউন প্রিন্স বানাতে হবে। হুসেইন এবং আব্দুল্লাহ রাজি হন।

বাদশাহ হুসেইনের মৃত্যুর আগে এবং পরের দিনগুলোতে সিংহাসনের এই খেলাকে কেন্দ্র করে হুসেইনের স্ত্রী নূর, এবং হাসানের স্ত্রী সারভাতের মধ্যে বেশ স্নায়ু যুদ্ধ চলে। তারা একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন অপপ্রচার চালান। নূর দাবি করেন, হুসেইনের মৃত্যুর আগেই সারভাত নিজের মতো করে প্রাসাদ সাজাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে সারভাত দাবি করেন, নূর ইহুদী বংশোদ্ভূত।

যাইহোক, শেষ পর্যন্ত আব্দু্ল্লাহ সিংহাসনে বসেন এবং তিনি তার সৎ মা নূরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেন। ক্ষমতা গ্রহণ করার পর প্রথমেই তিনি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দেন তার সৎ ভাই, প্রিন্স হামজাকে। কিন্তু কয়েক বছর পর, আব্দুল্লাহর নিজের ছেলে হুসেইনের বয়স যখন ১৮ বছর হয়, তখন তিনিও তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। হামজার মনোনয়ন বাতিল করে তিনি নিজের ছেলেকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মনোনয়ন দেন।

অনেকেই নিশ্চয়ই ভাবছেন জর্ডানের ক্রাউন প্রিন্সের সাথে পাকিস্তানের বাঙালি নারী সারভাত একরামউল্লাহর বিয়ে হয়েছিল কীভাবে? সেটি চমৎকার একটি গল্প – একটি রাজকীয় কাছে আসার গল্প।

বিয়ের পূর্বে সারভাত একরামউল্লাহ

পুরো ব্যাপারটির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আসলে সারভাতের মা, মিসেস শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী একরামউল্লাহর (সোহরাওয়ার্দীর মামাতো বোন) আতিথেয়তার। পঞ্চাশের দশকে সারভাতের বাবা মোহাম্মদ একরামউল্লাহ ছিলেন লন্ডনে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাই কমিশনার। একই সময় জর্ডানের বাদশাহ হুসেইনের ছোট ভাই হাসান লন্ডনে প্রিপারেটরি স্কুলে পড়াশোনা করছিলেন।

মিসেস একরামউল্লাহ সে সময় হাসানকে তাদের লন্ডনের বাসায় চায়ের দাওয়াত দেন। কিশোর হাসান তার আপ্যায়নে মুগ্ধ হন। এবং সে সময়ই তিনি একরামউল্লাহ পরিবারের ছেলেমেয়েদের সাথে পরিচিত হন, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া সারভাত।

প্রায় এক যুগেরও পরে, ১৯৬৮ সালে বাদশাহ হুসেইন যখন পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় সফরে যান, তখন হাসানও ছিলেন তার সফরসঙ্গী। মিসেস একরামউল্লাহর আতিথেয়তার কথা তখনও তার মনে ছিল। কাজেই পাকিস্তানে গিয়ে তিনি তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেখানেই সারভাতের সাথে তার আবার দেখা হয়, দীর্ঘদিন পর। সারভাত তখন সুন্দরী, ২০ বছরের যুবতী, যিনি কেমব্রিজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

সারভাতকে দেখেই হাসানের ভালো লেগে যায়। তার অনুরোধে বাদশাহ হুসেইন সারভাত এবং তার মাকে জর্ডান সফরে নিমন্ত্রণ জানান। বাকিটা ইতিহাস। কেমব্রিজের পরিবর্তে সারভাতের গন্তব্য হয় জর্ডান। ১৯৬৮ সালে করাচিতে তাদের বিয়ে হয়। সেই বিয়েতে আইয়ুব খান এবং বাদশাহ হুসেইন সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন: জর্ডানের হাশেমী রাজপরিবারের উত্থানের ইতিহাস

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *