গাদ্দাফির লিবিয়ায় ফিলিস্তিন (ফটোব্লগ)

আমাদের পুরো শৈশব-কৈশোরে আমরা টিভিতে “ইসরায়েল” নামটা শুনিনি। শুনেছি শুধু “ফিলিস্তিন” বা “দখলকৃত ফিলিস্তিক”।

ছোটকালে আমরা শুধু লিবিয়ান রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আল-জামাহিরিয়াই দেখতে পারতাম। বিটিভি দেখার সৌভাগ্য হয় নাই, বাট ধারণা করছি জামাহিরিয়া ছিল বিটিভিরই লিবিয়ান ভার্সন। সারাদিন শুধু গাদ্দাফিকেই দেখানো হতো।

সংবাদেও কোনো বৈচিত্র্য ছিল না। গাদ্দাফি কোথায় গিয়েছে, কী করেছে, কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে ফোনে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছে – শুধু সেগুলোরই ম্যারাথন বিবরণ।

মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং ইয়াসির আরাফাত ১৯৭৮ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে
মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং ইয়াসির আরাফাত ১৯৭৮ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে

এবং দুনিয়ার অন্য কোনো সংবাদ থাক বা না থাক, গাদ্দাফির সংবাদগুলোর পরেই নিয়মিত থাকত ফিলিস্তিনের সংবাদ। কোথায় সংঘর্ষ হয়েছে, কোথায় কয়জন ফিলিস্তিনি আহত বা নিহত হয়েছে, তার খুঁটিনাটি বর্ণনা। ফিলিস্তিনের সংবাদ দেখানো হয়নি – নব্বইয়ের দশকে এরকম কোনো দিনের কথা আমি মনে করতে পারি না।

কিন্তু ফিলিস্তিন সংক্রান্ত এই নিউজগুলোতে কখনো ইসরায়েল শব্দটা উচ্চারিত হতো বলে মনে পড়ে না। সংবাদ পাঠকরা ইসরায়েল না বলে বলত “ফালাস্তিন আল-মোহতাল্লা” তথা দখলকৃত ফিলিস্তিন। আর ইসরায়েলি সোলজার না বলে বলত “জাইশ আল-সাহইউনী” তথা জায়নিস্ট আর্মি।

ফিলিস্তিন নিয়ে গাদ্দাফির কিছুটা অবসেশন ছিল। গাদ্দাফির ক্ষমতায় আসার সুযোগই সৃষ্টি হয়েছিল ফিলিস্তিনের কারণে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ব্রিটিশপন্থী রাজা ইদ্রিস আল-সেনুসির নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে লিবিয়ানদের মধ্যে ইদ্রিসবিরোধী যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই গাদ্দাফির অভ্যুত্থানের পটভূমি রচনা করে দিয়েছিল।

গাদ্দাফির ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্ট তাই তাদের অভ্যুত্থানের অপারেশনটার নাম রেখেছিল “আমালিয়াত আল-কুদস”। আমালিয়া অর্থ অপারেশন, আর কুদস হচ্ছে জেরুজালেমের আরবি। অর্থাৎ তার অপারেশনটার নাম ছিল অপারেশন জেরুজালেম।

ক্ষমতায় আসার পরেও গাদ্দাফি বিভিন্নভাবে ফিলিস্তিনিদেরকে সাহায্য করেছিল। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই গাদ্দাফি লিবিয়া থেকে ইহুদি সম্প্রদায়কে পুরোপুরি উচ্ছেদ করেছিল, যদিও তার এই সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক ছিল তা নিয়ে আজও বিতর্ক আছে।

১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পটভূমিতে গাদ্দাফিই সর্বপ্রথম বাদশাহ ফয়সালকে তেলের দাম বাড়িয়ে আমেরিকাকে শায়েস্তা করার প্রস্তাব দিয়েছিল, এবং সেটা কার্যকরও হয়েছিল।

১৯৭৩ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য গাদ্দাফি লিবিয়ান সেনাবাহিনীর একটা ব্যাটালিয়নকে পাঠিয়েছিল, যদিও সেই ব্যাটালিয়ন সিনাই পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঐ ব্যাটালিয়নের একজন সদস্য (এবং কারো কারো মতে ঐ ব্যাটালিয়ানের মূল দায়িত্বে) ছিল আজকের ফিল্ড মার্শাল খালিফা হাফতার।

ইওম কিপুর যুদ্ধের পর আনোয়ার সাদাত যখন ইসরায়েলের সাথে সমঝোতায় গিয়েছিল, তখন গাদ্দাফি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল এবং প্রকাশ্যেই সাদাতকে ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান জানিয়েছিল। মিসরের সাথে লিবিয়ার সম্পর্ক তখন এত বেশি খারাপ হয়েছিল যে, মিসর লিবিয়ায় আক্রমণেরও পরিকল্পনা করছিল।

লিকড ডকুমেন্ট থেকে দেখা যায়, সাদাত তখন মার্কিন সরকারকে রিকোয়েস্ট করেছিল ইসরায়েলের কাছ থেকে নিশ্চয়তা আদায় করার জন্য যে, মিসরীয় সেনাবাহিনী যদি লিবিয়া আক্রমণে ব্যস্ত থাকে, সেই সুযোগে ইসরায়েল যেন মিসরে অ্যাটাক না করে।

গাদ্দাফি ছিল ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ এবং তার আমব্রেলা অর্গানাইজেশন পিএলওর অন্যতম ব্যাকার। কিন্তু ফাতাহ’র বাইরেও গাদ্দাফি অন্যান্য ফিলিস্তিনি গ্রুপকেও সাহায্য করত, যাদের অনেকেই পিএলওর চেয়ে অনেক বেশি অ্যাগ্রেসিভ ছিল। কার্লোস দ্য জ্যাকেল, আবু নিদালসহ অনেকেরই সাময়িক ঘাঁটি ছিল লিবিয়াতে।

মিউনিখ অপারেশনের পর আলি হাসান সালামার ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশনের জীবিত দুজন সদস্যকে যখন কোনো রাষ্ট্র আশ্রয় দেওয়ার সাহস পাচ্ছিল না, তখন গাদ্দাফির লিবিয়া তাদেরকে বীরের সম্মান দেখিয়ে এয়ারপোর্টে রিসিভ করেছিল।

পরবর্তীতে অবশ্য গাদ্দাফি তার এই ফিলিস্তিনপন্থী বিপ্লবী ভূমিকা থেকে সরে এসেছিল। লকারবির ঘটনার পর অবরোধে পড়ে গাদ্দাফির নিজের অবস্থাই তখন শোচনীয়। অন্যদেরকে ফান্ডিং করার সুযোগ কই? শেষপর্যন্ত যখন গাদ্দাফির অর্থনীতি আবার রিকভার করেছে, ততদিনে বিশ্বরাজনীতি অনেক পাল্টে গেছে।

মনে আছে ইয়াসির আরাফাত যখন ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি করেছিল, তখন গাদ্দাফি এতোই ক্ষিপ্ত হয়েছিল যে, সব ফিলিস্তিনিকে লিবিয়া থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। প্রথম কিছুদিন ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধর-পাকড় চলেছিল। পরে অবশ্য সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল।

কিন্তু একটা সময় পরে, ২০০০ সালের পরে, গাদ্দাফি নিজেই ইসরায়েলকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে হবে – এই নীতি থেকে সরে এসেছিল। আরো পরে জাতিসংঘের ভাষণে গাদ্দাফি টু স্টেট সল্যুশনের কথা পক্ষে কথা বলেছিল। এমনকি দুই দেশকে একত্রিত করে “ইসরাতিন” ফেডারেশন গঠন করার প্রস্তাবও দিয়েছিল।

ঘড়ির উপর গাদ্দাফি এবং আরাফাতের ছবি
ঘড়ির উপর গাদ্দাফি এবং আরাফাতের ছবি

অবশ্য সেগুলো ছিল নিছকই কথার কথা। বাস্তবে গাদ্দাফি সত্তর-আশির দশকে একাধিক আরব রাষ্ট্রের সাথে ফেডারেশন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ার পর আরব ইউনিটির আশা ছেড়ে দিয়ে আফ্রিকার দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেছিল।

ঠিক কবে থেকে সেটা খেয়াল করিনি, কিন্তু ধারণা করি নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকে বা নতুন সহস্রাব্দের শুরুর দিক থেকেই লিবিয়ান টিভি তাদের ইসরায়েলের নাম উচ্চারণ না করার অলিখিত নিয়ম থেকে সরে এসেছিল।

ফিলিস্তিন বিষয়ক আমার সকল লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে। আর ইয়াসির আরাফাতকে হত্যায় ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্লিক করুন এখানে

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *