ন ডরাই চলচ্চিত্রে আয়েশা বিতর্কের সমস্যা

ন ডরাই চলচ্চিত্রটার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিষয়বস্তু এবং দৃশ্যের পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে সমালোচকদের এবং মামলাকারীর একটা গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হচ্ছে, মূল চরিত্রের নাম আয়েশা রাখার মধ্য দিয়ে এখানে নাকি রসূল (স) এর স্ত্রী হযরত আয়েশা (রা) এর অবমাননা করা হয়েছে।

ন ডরাইয়ের আয়েশা, কিংবা ভূতের বাচ্চা সোলায়মানের সোলায়মান, এ ধরনের নাম নিয়ে বিতর্কের ভবিষ্যৎ হলো, সেফ সাইডে থাকার জন্য আগামী দিনগুলোতে কোনো গল্প-উপন্যাস বা চলচ্চিত্রে কেউ কোনো ইসলামি নাম ব্যবহার করবে না। আধুনিক বাংলা নাম ব্যবহার করবে।

এখন যারা এই নামগুলো নিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলছে, তখন তারাই আবার এর পেছনে ষড়যন্ত্র খুঁজে পাবে – যেখানে গ্রাম বাংলার প্রতিটা ঘরে ঘরে আরবি/ইসলামি নামই বেশি ব্যবহৃত হয়, সেখানে গল্প-উপন্যাসে বাংলা/হিন্দুয়ানি নাম ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে বাস্তবে কীভাবে সমাজের উপর ইসলামের প্রভাবকেই অস্বীকার করা হচ্ছে!

ন ডরাই দেখিনি, ভেতরে কী দেখানো আছে জানি না। কন্টেন্ট/দৃশ্য নিয়ে আপত্তি তোলা যেতেই পারে। আমি পুরোপুরি মুক্তমনা না, সো সেন্সর উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী না। বরং লিমিটেড সেন্সরের পক্ষপাতী। এবং সমাজের প্রেক্ষাপটে অশ্লীল, অনৈতিক, কিংবা সরাসরি কোনো ধর্ম/সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধ উস্কানি, নেতিবাচক প্রচার থাকলে সেটার প্রচারের আমি বিরোধী।

কিন্তু আমার মতে নাম বিতর্কটা একেবারেই বাড়াবাড়ি। এ ধরনের বাড়াবাড়ির ফলাফলটা কী হয়? ইসলাম জয়ী হয়? মোটেই না, বরং ক্ষমতাসীনরাই জয়ী হয়। এ ধরনের তুচ্ছ ধর্মীয় কারণে পপুলার অভিযোগের মামলায় সরকার যখন কোনো কিছু বন্ধ করে দেওয়ার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে, সেটা পরবর্তীতে তাদেরকে অন্যান্য ক্ষেত্রে অন্যান্য স্বাধীন মত বন্ধ করে দিতেও সহায়তা করে।

মিজানুর রহমান আজহারি সাহেবকে মাহফিল করতে দেওয়া হচ্ছে না বলে খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে? হওয়ারই কথা। আজহারি কিংবা তাহেরির কিছু বক্তব্য নিয়ে হাসাহাসি হতে পারে, কিন্তু তাদের কারো বক্তব্যেই এমন কিছু নাই, যেটার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে মামলা হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি আয়েশা নাম ব্যবহার করাকে নবীপত্নীর অবমাননা দাবি করেন, তখন অন্য কেউ যে আজহারি সাহেবের সিক্স প্যাককে বা অন্য কোনো বক্তব্যকে নবী অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করবে না, সে নিশ্চয়তা আপনাকে কে দিচ্ছে?

তবে নাম বিতর্কের ভিন্ন একটা অ্যাঙ্গেল আছে। সেটা সোলায়মান বিতর্কের সময় আমার মাথায়ও এসেছিল, এবং এখন আয়েশা বিতর্কেও কেউ কেউ বলছেন। সেটা হচ্ছে, এই দেশে কারো কি সাহস আছে “ভূতের বাচ্চা মুজিব” বা “দুঃসাহসী হাসিনা” নাম দিয়ে সিনেমা বানানোর? (ফেসবুকে একজনে জানালো, টাউট মুজিব নামে নাটকে অভিনয়ের কারণে জাহিদ হাসানকে অবাঞ্ছিতই ঘোষণা করা হয়েছিল!)

এই পয়েন্ট আসলেই সিরিয়াস। এরকম নামের সিনেমা তৈরি হলে যারা এখন মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার, তারাই সবার আগে সেটা নিষিদ্ধের এবং নির্মাতাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানাবে। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে, এই তুলনাটা আসলে এক্সট্রিম তুলনা।

মুজিব কিংবা হাসিনা নাম দুইটা হচ্ছে সমাজের একটা অংশের কাছে সর্বোচ্চ সম্মানের নাম। সেটার সাথে তুলনা করতে পারেন মোহাম্মদ নামের। কিন্তু তাই বলে সব নবী-রসুল, সাহাবায়ে কেরাম, পীর-বুজুর্গের নামের তালিকা যদি যোগ করা শুরু করেন, তাহলে যে বিশাল তালিকা তৈরি হবে, তাতে কোনো চরিত্রের নামকরণ করাই কঠিন হয়ে যাবে। মুজিব-হাসিনার বাইরে ধরেন কেউ যদি জয় বা পুতুল নামে কোনো নেগেটিভ চরিত্র তৈরি করে, তাহলে কি খুব বেশি রিঅ্যাকশন হবে? মনে হয় না।

নাম বিতর্কের ক্ষেত্রে তাই কিছুটা ছাড় দেওয়া উচিত। খুবই ব্যতিক্রমী নাম না হলে কিংবা কাহিনী ও বিষয়বস্তুর মধ্যে সরাসরি বিখ্যাত/সম্মানিত ব্যক্তির প্রতি কোনো ধরনের ইঙ্গিত করা না হলে এসব বিতর্ক এড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। কারণ কথায় কথায় এ ধরনের মামলা হলে ব্যাপারগুলো খেলো হয়ে যায়। এবং তখন সেটা থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নিতে পারে ক্ষমতাসীনরাই, সাধারণ জনগণ না।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *