ভাইরাসের নামকরণের রাজনীতি

চীনের উহান থেকে যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে, এখন পর্যন্ত তার কোনো আনুষ্ঠানিক নাম নেই। কেন নেই? কারণ ভাইরাসের নামকরণের ব্যাপারটা আসলে একটু জটিল। এ ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাসের নাম যা খুশি তা রেখে দেওয়া যায় না। অপরিকল্পিত নামকরণের প্রভাব অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদে খোদ ভাইরাসের চেয়েও বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সাময়িকভাবে ভাইরাসটির নাম দেওয়া হয়েছে 2019-nCoV, অর্থাৎ নভেল করোনা ভাইরাস ২০১৯। এবং এ কারণে গণমাধ্যমে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাসটি শুধুমাত্র করোনা ভাইরাস নামেই পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু করোনা কিংবা নভেল করোনা ২০১৯ – কোনোটিই অর্থবহ, পূর্ণাঙ্গ নাম না। করোনা ভাইরাস বলতে সুনির্দিষ্ট কিছুই বোঝা যায় না। এটি এই ধরনের ভাইরাসের সাধারণ নাম। এর আগের সার্স, মার্স-সহ অনেকগুলো ভাইরাসও ছিল করোনা ভাইরাস।

অনেক দেশের মিডিয়া ভাইরাসটিকে “উহান করোনা ভাইরাস” কিংবা “চাইনিজ ভাইরাস” নামেও অভিহিত করছে। কিন্তু ভাইরাসের নামকরণের ক্ষেত্রে এটি সম্পূর্ণ রীতিবিরোধী। এ কথা সত্য, বিংশ শতকে বিভিন্ন রোগের নামকরণের ক্ষেত্রে ভৌগলিক স্থানকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। যেমন স্প্যানিশ ফ্লু কিংবা ক্রিমিয়ান কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার। কিন্তু এখন নিয়ম অনেকটাই পাল্টে গেছে।

ভৌগলিক স্থানকে প্রাধান্য দিয়ে নামকরণের সমস্যা হচ্ছে, এতে ঐ ভৌগলিক এলাকার সাথে এই রোগের নাম পাকাপাকিভাবে যুক্ত হয়ে যায়। মানুষের মনে ঋণাত্মক ধারণার সৃষ্টি হয়, ঐ ভৌগলিক এলাকা হয়তো খারাপ, সেখান থেকেই এই রোগের সৃষ্টি হয়েছে।

অনেক সময় নামকরণের কারণে ভিন্ন ধরনের বিপত্তিও দেখা দেয়। যেমন ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার পর মিসর তাদের দেশ থেকে শুকর পুরোপুরি নির্মূল করে ফেলেছিল। অথচ সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসটা মোটেও শুকরের মাধ্যমে ছড়ায়নি। এ ধরনের ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা থেকে সে সময় আমেরিকার ন্যাশনাল পর্ক বোর্ড সোয়াইন ফ্লুর এই নামকরণের বিরোধিতাও করেছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার (World Health Organization – WHO) সাথে মিলে ভাইরাসের নামকরণের কাজটি সাধারণত করে থাকে International Committee on Taxonomy of Viruses (ICTV)। বর্তমানে নতুন যেকোনো ভাইরাসের নামকরণের জন্য যে “বেস্ট প্র্যাকটিসেস” অনুসরণ করা হয়, সেটি এরাই প্রণয়ন করেছিল ২০১৫ সালে। এই প্র্যাকটিস অনুযায়ী, ভাইরাসের নামকরণের ক্ষেত্রে কোনো মানুষ, প্রাণী কিংবা ভৌগলিক স্থানের নামের ব্যবহারকে অনুৎসাহিত করা হয়। এছাড়া নামের মধ্যে “unknown,” “death,” “fatal,” বা “epidemic” জাতীয় আতঙ্ক সৃষ্টিকারী শব্দ না রাখার ব্যাপারেও পরামর্শ দেওয়া হয়।

এর পরিবর্তে ভাইরাসের নামকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয় বিভিন্ন লক্ষণকে (যেমন respiratory, spongiform, deficiency), আক্রান্ত গোষ্ঠীকে (যেমন juvenile, pediatric, maternal), সময়ের ব্যাপ্তিকে (যেমন acute, transient), ঋতুকে (যেমন winter, summer), অথবা জাস্ট কিছু সংখ্যাকে (যেমন Alpha, beta, a, b, I,II,III, 1,2,3)।

এই পদ্ধতিতে ভাইরাসের নামগুলো বিশাল এবং সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন হয়ে যায়। ফলে অনেক সময়ই এদের অ্যাক্রনিম ব্যবহার করা হয়। যেমন সার্স (SARS) নামে যে ভাইরাসটি পরিচিতি পেয়েছিল, তার নাম আসলে ছিল severe acute respiratory syndrome। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেও অনেক সময় ঝামেলা হয়। যেমন SARS নামটা পুরোপুরি নিয়ম অনুসরণ করে রাখার পরেও এটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, যেহেতু নামটি ছিল SAR এর খুব কাছাকাছি।

SAR হচ্ছে হংকংয়ের চীনা প্রশাসনিক নাম, Special Administrative Region। SARS ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল ছিল চীন। কিন্তু নামটা SAR-এর খুব কাছাকাছি হওয়ায় এরকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল যে, এর উৎপত্তিস্থল আসলে হংকং। হংকংকে এর জন্য বেশ চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল।

বিতর্ক হয়েছিল MERS ভাইরাসের নামকরণের সময়ও। মার্স (MERS) এর পূর্ণরূপ Middle East respiratory syndrome। ২০১২ সালে এই ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল সৌদি আরব থেকে। প্রাথমিকভাবে ভাইরাসটির প্রস্তাবিত নামে সৌদি আরবের অদ্যাক্ষরগুলো ছিল। কিন্তু সৌদি আরব এতে আপত্তি জানায়। ফলে দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে ICTV বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সাথে আলোচনা করে এরপর MERS নামকরণের ব্যাপারে সম্মত হয়। ICTV-এর পরবর্তীতে সংশোধিত নিয়ম অনুযায়ী অবশ্য এই নামটিও সঠিক না, যেহেতু এখানে মধ্যপ্রাচ্যের নাম উল্লেখ আছে।

আরো পড়ুন: এক কবির কাছে খলিফা আল-মানসুর যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন

ভাইরাস যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন তার নামকরণের পেছনে সময় দেওয়াকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রভাব বিশাল। সময় মতো উপযুক্ত নামকরণ করা না গেলে যদি ভাইরাসটির নামের সাথে কোনো দেশের, জাতির বা গোষ্ঠীর নাম জড়িয়ে যায়, তাহলে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে।

ক্ষতিকর ভাইরাসের উৎপত্তিস্থলের সাথে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এছাড়াও কোনো জাতিগোষ্ঠীর সাথে নামের মিল থাকলে সেই জাতির প্রতি ঋণাত্মক মনোভাবও বিস্তৃতি লাভ করে। ভাইরাসের এক সময় ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়, কিন্তু ব্যবসায়িক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে ক্ষতি হয়, সেটা পুষিয়ে উঠতে সময় লাগে আরো অনেক বেশি।

দ্য আটলান্টিক অবলম্বনে।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *