লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (৫ম পর্ব): মৃত্যুর প্রতীক্ষায়

৩০ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। সকাল নয়টার দিকে আমরা শামীমদের বাসা থেকে বেরিয়ে আমাদের বাসার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। রকম ওয়াহেদে অবস্থিত ন্যাটোর বোমায় বিধ্বস্ত একটা স্কুল, বিদ্রোহীদের মিসাইলে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ওয়াহদা ব্যাংক এবং মেইন রোডের দুপাশে লুটপাট হওয়া দোকানপাটগুলো দেখতে দেখতে আমরা এগোচ্ছিলাম।

রাস্তাগুলো গাড়ি চলাচলের অযোগ্য। রকেট পড়ে জায়গায় জায়গায় রাস্তা গর্ত হয়ে আছে। হাইডলার রোড থেকে শুরু করে রকম ওয়াহেদ এবং রকম এতনিনের সামনের মেইন রোড এক থেকে দেড় ফিট পানির নিচে তলিয়ে আছে। সম্ভবত গোলার আঘাতে জায়গায় জায়গায় ফেটে যাওয়া পানির পাইপের কারণেই এ অবস্থা।

বোঝা গেল রকম তালাতা এবং সাওয়াওয়ার দিকেই এখনও যা কিছু মানুষের বসবাস আছে, রকম ওয়াহেদ প্রায় ফাঁকা। আর রকম এতনিন যেন একটা নির্জন ভূতুড়ে নগরীর কংকাল। পুরো রকম এতনিনে মাত্র একটা ফ্যামিলি ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলাম না।

রাস্তার গার্ডরা এদিন আমাদের থামিয়ে পরিচয় এবং গন্তব্য জানতে চাইল, কিন্তু বাধা দিলো না। বাসার কাছাকাছি পৌঁছে দেখতে পেলাম আমাদের বাসার পূর্ব দিকে যে রাস্তাটা সমুদ্রের পাড়ে উঠে গেছে, তার অপর পাশে মাতব্বর আঙ্কেলদের বাসার ঠিক সামনেই গাদ্দাফি-বাহিনী বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বসে আছে। বোঝা গেল এই এলাকাতে এটাই গাদ্দাফি-বাহিনীর মূল ঘাঁটি। সেখানে যে লিবিয়ান কমান্ডার, সে শাওন ভাইয়ার পূর্ব পরিচিত। সেও আমাদেরকে বাধা দিলো না। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম মাতব্বর আংকেলরা আরো আগেই বাসা ছেড়ে চলে গেছে।

অবরুদ্ধ অবস্থায় শুরুর দিনগুলো

বাসা পর্যন্ত যেতে আমাদের বেশ ঝামেলা হলো। রাস্তাগুলো উঁচু করে মাটি ফেলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এছাড়া জায়গায় জায়গায় পানিও জমে আছে। অবশেষে বাসায় এসে পৌঁছলাম। বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখি আমাদের মিনি বিড়ালটা আমাদেরকে দেখে পাগলের মতো মিয়াঁও মিয়াঁও চিৎকার করছে। দুই সপ্তাহ পার হওয়ার পরেও সে আমাদের বাসা ছেড়ে যায়নি।

এলাকার ভেতর দিয়ে আসার সময়ই লক্ষ্য করেছিলাম প্রতিটা বাড়ি খালি, কিন্তু বাড়িগুলোর দরজা-জানালা সব খোলা। তখন কারণটা বুঝতে পারিনি। আমাদের বাসায় ঢুকে দেখলাম বাসার সামনে যে উঠোনটা আছে, তার একপাশের দেয়াল ভাঙ্গা, অন্যপাশে একটা কাঠের দরজা ছিল বুড়ির বাড়িতে যাওয়ার জন্য, সেটাও খোলা। স্পষ্টতই গাদ্দাফির যোদ্ধারা প্রতিটা বাসার ভেতরে ঢুকে নিজেদের প্রয়োজন মতো দেয়ালগুলো ভেঙ্গে রাস্তা তৈরি করে নিয়েছে, যেন জরুরী অবস্থায় যেকোনো দিক দিয়ে আসা যাওয়া করতে পারে।

উঠোনে মাটির চুলাটার পাশেই একটা করলা গাছ লাগানো ছিল, সেই গাছের চালার উপরে দেখলাম একটা কালাশনিকভ রাইফেল রাখা। নামালে কোন ঝামেলায় পড়ি, আব্বু তাই সেটাকে না নামিয়ে গাছের পাতাগুলো দিয়ে আরো ঢেকে ঢুকে রাখল।

বাসার অবস্থা কাহিল। ধুলোবালি আর বুলেটের খোসায় উঠোন ভর্তি হয়ে আছে। সেগুলো পরিষ্কার করে তাড়াতাড়ি লাকড়ির চুলায় রান্না চড়িয়ে দিলাম, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আর বাইরে রান্না করা যাবে না। রান্নাবান্না সেরে পাশের মুক্তাদের বাসায় গেলাম তাদের খোঁজ নিতে। দেখলাম ওরা ভালোই আছে। মুক্তার আব্বা আমিনুর আঙ্কেলের দুই বন্ধু খান এবং শাহীনও তাদের সাথে আছে। এছাড়া আরেকটু দূরে রাস্তার মুখে থাকত হিরণ ভাইয়ের ফ্যামিলি, তারাও মুক্তাদের বাসায় এসে উঠেছে।

তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম নবী স্যাররা, রমজান আঙ্কেলরা আর আলিম আঙ্কেলরা সবাই সিরতের দক্ষিণে অবস্থিত গার্বিয়াত নামক এলাকায় গিয়ে উঠেছে। ঐ এলাকার অধিবাসীরা অধিকাংশই ফারজানি কাবিলার এবং তারা বিদ্রোহীদের পক্ষে। কাজেই আশা করা যায় ঐ এলাকায় যুদ্ধ হবে না এবং তারা নিরাপদেই থাকবে। সৌরভদের কথা কেউ বলতে পারল না। তারাও হয়তো গার্বিয়াতে গিয়ে থাকতে পারে, অথবা ইবনে সিনা হসপিটালের আবাসিক ভবনেও গিয়ে উঠতে পারে।

জাফরানের দিকে বেশ কদিন ধরে যুদ্ধ হয় নি, এদিনও হলো না। তবে রকম তালাতার দিক থেকে সারাদিনই যুদ্ধের আওয়াজ পাওয়া যেতে লাগলো। সারাদিন আমরা ঘরেই কাটালাম আর দেখলাম আশেপাশে গাদ্দাফির সৈন্যরা হেঁটে হেঁটে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। মাতব্বর আঙ্কেলদের বাসার সামনে দেখা কমান্ডারটা লিবিয়ান হলেও এলাকার ভেতরে যেসব সৈন্য ঘুরছিল, তাদের অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। হয়তো চাদ, নাইজার বা মৌরিতানিয়ার, অথবা তাওয়ার্গার বা দক্ষিণের কৃষ্ণাঙ্গ লিবিয়ান। তাদের অনেককেই দেখলাম টহল দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দরজা খোলা বাসার ভেতরে ঢুকছে এবং বস্তায় ভরে বিভিন্ন জিনিস নিয়ে যাচ্ছে।

শনিবার সকাল থেকে রকম তালাতার দিক থেকে ভয়াবহ যুদ্ধের আওয়াজ আসতে লাগলো। সারাদিন প্রচণ্ড যুদ্ধ চলল। রবিবার বিকেলে আতেফ আর হামজা বাসায় ফিরল। জানাল, রকম তালাতায় থাকা সম্ভব না। সেখানে জয়নবের বাবাদের সামনের বাসাতেই মিসাইল পড়েছে। সেই বাসার দেয়ালের ভাঙ্গা টুকরা জয়নবের বাবাদের বাসায় এসে ঢুকেছে। এছাড়া বিদ্রোহীরা সিরতবাসীকে আত্মসমর্পণ করার জন্য, নইলে সিরত ছেড়ে যাওয়ার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে।

তাই বুড়িরা এবং জয়নবের বাবারা সবাই আগামীকাল ভোরেই ঘর ছেড়ে গার্বিয়াতে তাদের এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে উঠবে। আম্মু আর তিথিকে তারা তাদের সাথেই নিয়ে যাবে, কিন্তু গাড়িতে জায়গা হবে না বলে আমাদেরকে নিতে পারবে না। যদি পরে সুযোগ পায় তাহলে এসে আমাদেরকে নিয়ে যাবে।

আতেফ আর হামজা যাওয়ার সময় বুড়ির বাড়ির স্টোরের চাবি আমাদেরকে দিয়ে বলে গেল যুদ্ধ যখন চলবে না তখন সময় বুঝে আতেফের বাসা থেকে জামা-কাপড়, কার্পেট ইত্যাদি এনে স্টোরে রাখতে। আতেফের বাসাটা এই এলাকার সবচেয়ে বিলাসবহুল বাসার মধ্যে একটা। কিন্তু প্রথম দিকের গোলাগুলিতেই তার বাসার বিভিন্ন কাঁচের দেয়াল, জানালা ভেঙ্গে পড়ে গেছে, মূল দরজা ভেঙ্গে গেছে। তার ভয় যেকোনো সময় একটা শেল এসে পড়লে ঘরে আগুন ধরে যেতে পারে। যাওয়ার সময় আমাদেরকে প্রয়োজনে স্টোর থেকে তেল-চিনিসহ বিভিন্ন খাবার জিনিস ব্যবহার করতেও বলে গেল।

পরদিন সোমবার থেকে জাফরানের দিকেও যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তবে যুদ্ধ শুধু বিকেল বেলাই হতো। সন্ধ্যার আগে আগে হঠাৎ প্রচণ্ড আকার ধারণ করত, এরপর হঠাৎ করেই আবার থেমে যেত। সকালের দিকে আমরা আতেফের বাসায় গিয়ে তার কাপড়-চোপড়গুলো সরিয়ে আনতাম। কিন্তু দুদিন না যেতেই একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, রাতের বেলা আতেফের বাসায় মানুষ ঢোকে। কারণ প্রতিদিন গিয়েই দেখি কিছু না কিছু জিনিস নেই। অবশ্য বেশির ভাগই খাবার-দাবার আর ছোটখাটো দামি জিনিস।

টিভি, স্যাটেলাইট রিসিভারসহ দামি জিনিসগুলো বাঁচানোর জন্য একদিন আমি সেগুলো একটা রুমে ঢুকিয়ে সেই রুমটা লক করে তার চাবি বাথরুমে লুকিয়ে রাখলাম। পরদিন সকালে গিয়ে দেখি হিতে-বিপরীত। সেই রুমের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে সব জিনিসপত্র উলট-পালট করে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালানো হয়েছে। রাতের বেলা কারেন্ট থাকে না, ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেও প্রতিদিন কে ঢোকে সেটা একটা রহস্যই বটে!

পরদিনই অবশ্য রহস্যের আংশিক সমাধান হল। সকালে গিয়ে দেখি আতেফের রান্নাঘরে একটা রকেট লঞ্চারের রকেটের প্যাকেট রাখা। একেবারে নতুন, এখনও খোলা হয়নি। সম্ভবত যে সৈন্যটা ঢুকেছিল সে তল্লাশি চালানোর জন্য প্যাকেটটা এখানে রেখে গিয়েছিল, পরে ভুলে গেছে। এদিন গিয়ে দেখি ফ্রিজের মধ্যে হাফ কেজি বাটারের যে প্যাকেটটা ছিল, সেটাও গায়েব।

আমাদের ঘরে নাশতা করার কিছু নেই, আর গাদ্দাফির সৈন্যরা কি না পাশের ঘরে ঢুকে খাবার চুরি করে নিয়ে যায়! কাজেই এদিন আমরা আতেফের রান্নাঘর থেকে কফির বোতল, টুনা মাছসহ টুকটাক যেসব খাবার ছিল, সেগুলো নিয়ে গেলাম। শুধু কিছু পেঁয়াজ-রসুন ছিল, সেগুলো নিলাম না। পরদিন গিয়ে দেখি সেগুলোও নেই।

ঘরে আমাদের জীবন প্রচণ্ড একঘেয়েমির মধ্যে কাটতে লাগলো। সকাল ছয়টা-সাতটার দিকে ঘুম থেকে উঠে লাকড়ির চুলায় রুটি বানানো শুরু করি। নাশতা খেয়ে সেরেই আবার ভাত আর তরকারি রান্না শুরু করে দেই। তরকারি বলতে গাছের পেঁপে, করলা আর ডাল। রান্না-বান্নার কাজ মূলত শাওন ভাইয়াই করে, আমি মাঝেমাঝে সাহায্য করি।

দুপুরের খাওয়া শেষ হতে না হতেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আমরা সবাই ঘরের একেবারে মাঝখানে তিথির রুমটাতে মাটিতে ম্যাট্রেস বিছিয়ে তার উপরে বসে থাকি। আশেপাশে মিসাইল এসে পড়তে থাকে, মেশিনগানের একটানা শব্দে কান বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। একেকটা মিসাইল পড়ার সাথে সাথে পুরো ঘর কেঁপে উঠে, আমাদের মিনি বিড়ালটা ভয়ে এক দৌড়ে খাটের নিচে এক কোণে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে, আর আমরা বসে বসে আল্লাহ‌্‌ আল্লাহ্‌ করতে থাকি।

ঘর থেকে তো বের হতে পারিই না, ঘরের ভেতরও একটু জোরে কথা বলতে পারি না। কারণ আমাদের বাসার ঠিক সামনে থেকেই গাদ্দাফির তিন-চারটা সৈন্য ফায়ার করতে থাকে। মাঝে মাঝে গুলি ভরার জন্য বুড়ির গ্যারেজেও ঢুকে যায়। ছোট্ট একটা বাসার মধ্যে দিনের পর দিন বন্দীর মতো কাটানোটা অসহ্য হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে মনে চায় ডাক ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদি। প্রচণ্ড একাকীত্বে হতাশ মানুষ কেন আত্মহত্যা করে, তার কিছুটা এখন অনুমান করতে পারি।

সন্ধ্যার দিকে যুদ্ধ থেমে যায়, কিন্তু শুরু হয় ন্যাটোর ওড়াউড়ি। এরা যে কীজন্য ওড়ে, কে জানে? ১৯শে মার্চ, যেদিন গাদ্দাফি-বাহিনী শতশত ট্যাংক নিয়ে বেনগাজিতে ঢুকে পড়ছিল, সেদিন সেই ট্যাংকগুলো ধ্বংস করাই সম্ভবত ন্যাটোর একমাত্র কাজের কাজ ছিল। কিন্তু এরপর থেকে যত আক্রমণ করেছে, তার অধিকাংশই অপ্রয়োজনে। মার্চ-এপ্রিলের দিকে তো বিদ্রোহীদের উপরও বেশ কয়েকবার ন্যাটো হামলা করেছে। সিরতে ন্যাটো যতগুলো হামলা করেছে, তার অধিকাংশই খালি জায়গায় অথবা বিভিন্ন আর্মি অফিসারের ফাঁকা বাড়িতে, অথবা এমন অস্ত্রভাণ্ডারে যেখান থেকে মাত্র কয়েকদিন আগে সব অস্ত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

রোজার মাসে একদিন সিরতের একটা রেস্ট হাউজে গাদ্দাফির দুই ছেলের পরিবার এসে উঠেছে, এরকম একটা গুজব শোনা গেল। সেদিন ন্যাটো ঐ এলাকায় লিফলেট ফেলল যেন সাধারণ মানুষ ঐ এলাকা ছেড়ে চলে যায়, ওখানে হামলা করা হবে। ঠিকই তার দুই দিন পর, যখন গাদ্দাফির ছেলের পরিবার ঐ এলাকা ছেড়ে চলে গেল, ভেতরে রাখা অস্ত্র-শস্ত্র সরিয়ে ফেলা হলো, তারপর ন্যাটো ওখানে বোমা মারল। ন্যাটোর মূল উদ্দেশ্য মনে হয় লিবিয়ার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ধ্বংস করা, যেন পশ্চিমা দেশগুলোই যুদ্ধের পরে রিকনস্ট্রাকশনের কাজগুলো পায়। আর সেই সাথে লোক দেখানো বোমা মেরে যুদ্ধটাকে যথাসম্ভব দীর্ঘায়িত করা।

এই যেমন এখন সিরতে যে যুদ্ধটা চলছে, সেখানে গাদ্দাফি-বাহিনী অল্প কয়েকটা জায়গা থেকে মিসাইল মারছে। রকম তালাতায় শামীমদের বাসার পেছনের সেই গাছপালা ঢাকা বাড়িটা থেকে, রকম এতনিনে মাতব্বর আঙ্কেলের বাসার সামনে থেকে, এছাড়া আরো কয়েকটা হাতে গোনা দোতলা বাড়ির ভেতর থেকে। আমরা আতেফের দোতলায় উঠে জানালা দিয়ে তাকালে দিনের বেলাতেও স্পষ্ট দেখতে পাই আগুনের গোলা ঠিক কোথা থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়ে পড়ছে। আর দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা উড়ে ন্যাটো সেটা দেখতে পায় না? এই কয়েকটা পয়েন্টে বোমা মারলেই যুদ্ধটা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ন্যাটো এখানে না মেরে মারে অপ্রয়োজনীয় জায়গায়।

তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, আফগানিস্তান, ইরাক আর পাকিস্তানে ন্যাটো যেরকম উল্টাপাল্টা সাধারণ জনগণের উপর আক্রমণ করে, লিবিয়াতে সেরকম করেনি। লিবিয়াতে ন্যাটোর আক্রমণে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর মধ্যে আছে ১৩ই মে ব্রেগায় একটা রেস্ট হাউজে ১১ জন ইমাম, ১৯ জুন ত্রিপোলিতে একটা ভবনে ১৫ জন সাধারণ মানুষ, ২০ জুন ৩ শিশু সহ আরো ১৯ জন, জুলাইয়ে জিলিতনে ৯ জন, আগস্টে জিলিতনে একটা পাঁচতলা ভবনের আরো ৮৫ জনের (সরকারী দাবি, সাংবাদিকদের অবশ্য ৩৫টার বেশি লাশ দেখানো হয়নি) মৃত্যু এবং এরকম আরো পাঁচ-ছয়টা কেস।

এছাড়া বাকি সবগুলো বোমাই ন্যাটো মিলিটারিদের উপর এবং মিলিটারি সম্পর্কিত জায়গাতেই মেরেছে। ত্রিপোলি দখল হওয়ার দিন পর্যন্ত লিবিয়াতে ন্যাটো মোট বোমা মেরেছে সাড়ে সাত হাজার। এর মধ্যে গোটা দশেক যদি সিভিলিয়ানদের উপর পড়ে, তবে ন্যাটোর বিশ্বব্যাপী হত্যা মিশনের ভূমিকার তুলনায় সেটাকে কমই বলতে হবে।

প্রথম সপ্তাহটা মোটামুটি একই রকম কাটল। দুপুরের পর যুদ্ধ শুরু হয়ে সন্ধ্যার দিকে থেমে যায়। কিন্তু ৭ অক্টোবর শুক্রবার থেকে রুটিন পরিবর্তিত হয়ে গেল। এদিন ভোর ছয়টার সময় যুদ্ধ শুরু হয়ে সারাদিন চলল। এরপর থেকে প্রতিদিনই সকাল দশটার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়, সারাদিন চলে সন্ধ্যার দিকে শেষ হয়। এই গোলাগুলির মধ্যে লাকড়ির চুলায় রান্না করা অসম্ভব তাই আমরা বুড়ির স্টোরে একটা অর্ধেক ভরা গ্যাস সিলিন্ডার পেলাম, সেটা এনে ব্যবহার করতে শুরু করলাম।

সারাদিন আমরা রান্নাবান্না ছাড়া বাকি পুরো সময়টা তিথির রুমে নিচে বসে থাকি। সন্ধ্যার পর শুধু এশার আজানের জন্য অপেক্ষা করি। আশেপাশের মসজিদগুলো পরিত্যক্ত, তাই অনুমান করে আটটার দিকে নামাজ পড়ে খেয়েই শুয়ে পড়ি। আগে শুধু দিনেই যুদ্ধ হতো। কিন্তু এখন দুই ঘণ্টা ঘুমানোর পরেই মিসাইলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। রাত দশটা-এগারোটার দিকে একবার ঘণ্টা খানেকের জন্য আবার রাত তিনটা-চারটার দিকে আরেকবার ঘণ্টা খানেকের জন্য মিসাইল আক্রমণ শুরু হয়।

দিন যত এগোতে লাগলো, যুদ্ধের তীব্রতা ততই বাড়তে লাগলো। সারাদিন প্রচণ্ড রকেট হামলা আর গোলাগুলির পর সন্ধ্যার সময় যখন থামে, তখন ওয়ালের উপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখি পুরো রকম এতনিনে আগুনের ধোঁয়ার জন্য কিছু চোখে দেখা যাচ্ছে না।

শব্দ শুনে অনুমান করছিলাম বিদ্রোহীরা সম্ভবত একদিকে হাইডলার আর অন্যদিকে বিন হাম্মাল মসজিদ পর্যন্ত ঢুকে গেছে। ন্যাটোর ওড়াউড়ি দেখে সেটা আরো পরিষ্কার বোঝা গেল। আগে ন্যাটো এতো উপর দিয়ে উড়ত যে দেখাই যেত না, কিন্তু এখন একেবারে পরিষ্কার দেখা যায়। আর এখন ঠিক আমাদের মাথার উপর দিয়েই, অর্থাৎ শুধু রকম এতনিন আর রকম ওয়াহেদের উপর দিয়েই বারবার ঘুরে ঘুরে ওড়ে। কিন্তু কথা হচ্ছে মাত্র এই এতটুকু এলাকাই যদি দখল করা বাকি থাকে, তাহলে বিদ্রোহীরা এখনও দখল করতে পারছে না কেন?

মূল যারা লিবিয়ান, তাদের অধিকাংশই যুদ্ধের শুরুতেই পালিয়েছে। যুদ্ধ যারা করছে তাদের অধিকাংশই আফ্রিকান মোরতাজাকা (মার্সেনারি) অথবা কৃষ্ণাঙ্গ লিবিয়ান। আমরা যতটুকু দেখছি, আমাদের এলাকাটায় গাদ্দাফির সৈন্যের সংখ্যা খুব বেশি হলে পঞ্চাশ জন। পুরো সিরতে এই মুহূর্তে গাদ্দাফির সৈন্য সংখ্যা খুব বেশি হলে তিনশ জন। এই কয়জনকে বিদ্রোহীরা হারাতে পারছে না!

তবে কি এতদিন ধরে যেগুলোকে আমরা গাদ্দাফির মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা মনে করতাম, সেগুলোই আসলে সত্য? পশ্চিমা মিডিয়ার সংবাদগুলোই প্রোপাগান্ডা? বিদ্রোহীরা আসলেই সংখ্যায় খুবই কম? মাত্র কয়েকশো? কিন্তু তাহলে মাত্র এক রাতের মধ্যে ত্রিপোলি দখল করল কীভাবে? একই সাথে সিরত, সাবহা আর বানিওয়ালিদের মতো তিনটা শক্তিশালী শহর আক্রমণ করার মতো সাহস পেল কীভাবে? আমি কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না।

১০ তারিখের দিকে যুদ্ধ ভয়াবহ আকার ধারণ করল। এখন প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই যুদ্ধ চলে। কামালের বাসায় আগেই একদিন একটা রকেট পড়ে দুইটা রুম পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এদিন সন্ধ্যার সময় আতেফের বাড়িতেও দুইটা মিসাইল এসে ঢুকে একতলা-দোতলা দুটোকেই ধ্বংস করে দিল। প্রচণ্ড শব্দে আর গরম বাতাসের ঝাপটায় আমরা কেঁপে উঠলাম। ঘরের ভেতর কুপি বাতি জ্বলছিল, সেটাও নিভে গেল। এই প্রথম আমাদের এত কাছাকাছি মিসাইল পড়ল।

মিসাইল যখন দূরে পড়ে, তখন পড়ার আগে কয়েক সেকেন্ড ধরে শোঁ করে বাতাস কেটে যাওয়ার একটা শব্দ শোনা যায়, এরপর ফাটার আওয়াজটা আসে। কিন্তু যখন একেবারে কাছে পড়ে, তখন শোঁ শব্দটা শোনা যায় না, কিছু বুঝে উঠার আগেই একেবারে হঠাৎ করেই প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়ে।

পরদিন ১১ তারিখ দুপুরে আমি আমার টিনের ছাদওয়ালা রুমটাতে বসেছিলাম। হঠাৎ উঠোনের ঠিক বাইরেই একটা রকেট এসে পড়ল, ধোঁয়ায় চারদিক ভরে গেল, রকেটের ভাঙ্গা লোহার টুকরাগুলো উঠোনে এসে পড়তে লাগলো। আমি একটা চিৎকার করে লাফিয়ে তিথির রুমে গিয়ে ঢুকলাম। এর কিছুক্ষণ পরেই আশেপাশে একেবারে কাছেই আরো কয়েকটা মিসাইল এসে পড়ল, সেগুলো পড়ার সাথে সাথে ঘরের ছাদ আর ছাদে ঝুলানো সিলিং ফ্যান এমন ভাবে কাঁপতে লাগলো, মনে হলো যেন ছাদ ভেঙ্গে মাথার উপর এসে পড়বে।

১২ অক্টোবর, বুধবার

ঘুম থেকে উঠে দেখি লাইনে পানি নেই। হয়তো বিদ্রোহীরা লাইন কেটে দিয়েছি, অথবা মিসাইল পড়ে কোথাও পাইপ ফেটে গেছে। আশেপাশে পানি আছে কি না দেখার জন্য একটু বের হলাম, দেখি মুক্তাদের বাসার সামনে সালেম মেরোয়াহ্‌দের বাসার দোতলার বারান্দা ভেঙ্গে পড়ে আছে, মোহাম্মদের বাসার একপাশের দেয়াল ভেঙ্গে আছে। তার সামনে ওমর কাসেমদের বাড়ির দোতলার ভেতরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আমার আরেকটু সামনে গিয়ে দেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু দেখি গাদ্দাফি-বাহিনীর পনের-বিশ জন কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্য লাইন ধরে দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে সামনের দিকে যাচ্ছে সম্ভবত কোনো অ্যাটাক করার জন্য।

আশেপাশে বোমা পড়ার কম্পনে আমাদের বেডরুমের কাঠের জানালাটা প্রায় ভেঙ্গে যাচ্ছিল। দুপুরের দিকে আব্বু যখন সেটা ঠিক করছিল, তখন শব্দ শুনতে পেয়ে দুইজন সৈন্য দেয়াল টপকে আমাদের বাসায় ঢুকে গেল। দুজনই আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে ধরে আছে।

এলাকার লিবিয়ান যোদ্ধা হলে কথা ছিল না, তারা সবাই আমাদেরকে চেনে, কিন্তু এরা আফ্রিকান অথবা দক্ষিণের কৃষ্ণাঙ্গ লিবিয়ান, জীবনে কখনও এদেরকে দেখিনি। তারাও আমাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলো। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, কী করছি, আর কে আছে, বিদ্রোহীদের দেখেছি কি না, ইত্যাদি।

তাদের কাছ থেকেই জানতে পারলাম বিদ্রোহীরা খুব কাছে এসে গেছে, রাতের বেলা তারা গোপনে এই এলাকাতেও ঢোকে। সৈন্য দুটো আমাদেরকে জিজ্ঞেস করল এলাকায় বাংলাদেশী আর কে আছে। আমরা মুক্তাদের বাসাটা দেখানোর জন্য হুট করে দরজা খুলতে যেতেই সে ধমকে উঠল আস্তে দরজা খোলার জন্য। তারপর নিজের হাতেই খুব ধীরে ধীরে দরজা খুলে একটু মুখ বের করে দুই পাশে উঁকি মারল। তারপর দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে হেঁটে চলে যেতে লাগল। আমাদেরকে বলে গেল ঘর থেকে যেন বের না হই, আর যদি জেরদানদেরকে (ইঁদুরগুলোকে, অর্থাৎ বিদ্রোহীদেরকে) দেখি, তাহলে যেন তাদেরকে জানাই।

দুপুরের দিকে হিরণ ভাই আমাদের বাসায় এলো পানি আছে কি না দেখার জন্য। হিরণ ভাই জানাল সকালে সে তার বাসার সামনের বাগানে গিয়েছিল গাছ থেকে লাউ-টাউ কিছু পাওয়া যায় কি না, দেখতে। এমন সময় চার-পাঁচজন গাদ্দাফির সৈন্য এসে তার গলার মধ্যে রাইফেল ধরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল, তার ঘর চেক করল। পরে যখন বুঝতে পারল যে সে সাধারণ মানুষ তখন ধাক্কা দিয়ে বলল, যেখানে ছিলা সেখানে ফিরে যাও। আর যদি কখনো বাইরে দেখি সোজা গুলি করে দিব। হিরণ ভাই তখন বলল, ঘরে পানি নাই, তাছাড়া যেভাবে মিসাইল পড়ে, ঘরে থাকা সম্ভব না। সৈন্যগুলো বলল, সেটা আমরা জানি না। ঘরে ঢুকে বসে থাক। আমরা কিছু করতে পারব না।

১৩ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার

আমাদের বাসার দুই পাশের দরজার সামনে আরো দুটো মিসাইল পড়ল। লোহার তৈরি দুটো দরজাই গরম লোহার টুকরার আঘাতে ছিদ্র ছিদ্র হয়ে গেল। এদিন বুড়ির বাসার দেয়ালেও একটা রকেট এসে পড়ল, কিন্তু ফাটল না।

মোহাম্মদের বাসার একপাশে আগের দিন একটা পড়েছিল, এদিন উল্টা পাশেও একটা ১০৬ মিমি মিসাইল এসে পড়ল। বোমার আঘাতে মোহাম্মদের দুটো দরজাই ভেঙ্গে গেল। দেখার জন্য আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি এর মধ্যেই কেউ এসে ম্যাট্রেস, কার্পেট, জামা-কাপড় উল্টেপাল্টে তল্লাশি চালিয়ে গেছে।

কামালের বাসায় আগেই মিসাইল পড়েছিল। এদিন সেটা দেখতে গিয়ে দেখি সেখানেও একইভাবে তল্লাশি চালানো হয়েছে। এছাড়া সেখানেও একটা আরপিজির রকেটের প্যাকেট দেখতে পেলাম। আতেফের বাসায় এদিন আর ঢুকতে পারলাম না। কারণ বাইরে থেকেই বুঝতে পারলাম কেউ একজন ভেতরে আছে।

আগে শুধু রাতের বেলাই আতেফের বাসায় ঢুকত, এখন দিনের বেলাও ঢোকে। বাসাটার সিঁড়িঘরে উঠলে পুরো এলাকাটা নজরে পড়ে। তাই সম্ভবত একজন স্নাইপার মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে চারদিকে নজর রাখে। এদিন বিকেলে আমার টিনের রুম ছিদ্র হয়ে একটা বুলেট ঢুকে ঘরের ভেতর পড়ল। ভাগ্য ভাল, ঐ মুহূর্তে কেউ ঐ রুমে ছিলাম না।

১৪ই অক্টোবর, শুক্রবার

আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ রাত। সারাদিন যুদ্ধ চলার পর এদিন রাত তিনটার দিকে হঠাৎ প্রচণ্ড মিসাইল আক্রমণ শুরু হল। এবং সবগুলো মিসাইল একেবারে আমাদের ঘরের আশেপাশেই পড়তে লাগলো। শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে মিসাইলগুলো মারা হচ্ছে এক কিলোমিটার এরও কম দূর থেকে। ঢং, ঢং, ঢং করে দূর থেকে মারার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, তার সাথে সাথেই শোঁ-ধ্রাম, শোঁ-ধ্রাম করে মিসাইলগুলো এসে পড়ছে।

একেকটা মিসাইল পড়ার সাথে সাথে পুরো ঘর ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠছে। আর তার প্রায় সাথে সাথেই মিসাইলের ছোট টুকরাগুলো আমাদের ছাদে এবং উঠোনে এসে পড়ছে। শুয়ে থাকা অসম্ভব, আমরা উঠে সিদ্ধান্ত নিলাম, হামজার নতুন তৈরি করা বাসায় গিয়ে ঢুকব। যে হারে মিসাইল আসছে, যেকোনো মুহূর্তে আমাদের ঘরেও পড়তে পারে। আর একটা পড়লেই পুরানো আমলের বাড়ির ছাদ একেবারে ধসে যাবে।

ঘুটঘুটে অন্ধকার, তাই আমরা কুপি বাতি জ্বালিয়ে একজন একজন করে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা করে মিসাইল পড়ে, সাথে সাথে একজন করে দৌড়ে হামজার বাড়িতে ঢুকে যাই। আমরা হামজার বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথেই গাদ্দাফি-বাহিনী খুব কাছ থেকেই মেশিনগানের ফায়ার শুরু করল। আমরা প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেলাম। কারণ রাতের বেলা মিসাইল আক্রমণ নিয়মিত ঘটনা, কিন্তু মেশিনগানের ফায়ার এই প্রথম। আমাদের সন্দেহ হলো, আমাদের কুপি বাতির আলো দূর থেকে দেখে ফেলে সন্দেহ করে বসে নি তো? মাটিতে বসে বসে আমরা মনে মনে দোয়া-দরূদ পড়তে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পরেই বিদ্রোহীদের দিক থেকেও পাল্টা ফায়ার শোনা যেতে লাগলো। সেই সাথে মনে হলো রমজান আঙ্কেলদের বাসার দিক থেকে বিরোধীদের চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি। বিদ্রোহীরা সম্ভবত রাতের অন্ধকারেই ঢুকে যেতে চেষ্টা করছে। আমাদের ভয় হলো, এখন যদি বিদ্রোহীরা এই এলাকায় ঢুকে পড়ে, আর কোন ভাবে টের পায় এই বাসার ভেতরে কেউ আছে, তাহলে নিঃসন্দেহে ব্রাশ ফায়ার করে দিবে। ওরা তো আর জানে না, শহরের ভেতরে এখনও কোনো সিভিলিয়ান আছে। তাই আমরা এই প্রচণ্ড মিসাইল আক্রমণ আর মেশিনগানের গোলাগুলির মধ্যেই আবারও বাতি না জ্বালিয়েই হাতড়ে হাতড়ে ঘরে ফিরে এলাম।

সেদিন আমাদের বাসার ১০০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে অন্তত দুই-তিনশো মিসাইল মারল বিদ্রোহীরা। কিছুক্ষণ পরেই ধীরে ধীরে মিসাইলগুলো আরেকটু পূর্ব দিকে, অর্থাৎ রকম এতনিনের ভেতর দিকে গিয়ে পড়তে লাগলো। বুঝতে পারলাম, বিদ্রোহীরা একটা একটা করে এলাকা ক্লিয়ার করছে। তাদের হিসেব অনুযায়ী আমাদের এলাকাটা নিশ্চয়ই ক্লিয়ার হয়ে গেছে, এখানে আর কোনো মানুষ থাকার কথা না। কিন্তু আল্লাহ্‌ আমাদের রক্ষা করেছে, এই ভয়াবহ আক্রমণের মধ্যে দিয়েও অকল্পনীয়ভাবে আমরা বেঁচে আছি।

সিরত যুদ্ধ সম্ভবত শেষ পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। কিন্তু এই শেষটা কী আমাদের জন্য ভালো হবে, না খারাপ হবে? প্রথমে যখন ন্যাটো বোমা মারত, তখন আমি মোটেই ভয় পেতাম না। মনে হতো, কত বড় দেশ, এর মধ্যে ঠিক কি আমাদের উপরেই বোমা এসে পড়বে? প্রবাবিলিটি বলে একটা কথা আছে না?

কিন্তু এখন যে হারে মিসাইল পড়ছে, প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় মনে হয়, আজই বুঝি জীবনের শেষ রাত। এতদিন যে বেঁচে আছি, সেটাই তো ভাগ্য! এই যুদ্ধ আর নার্ভে সহ্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মরলে মরি, তবুও যেন বিদ্রোহীরা ঢুকে যায়, তবুও যেন যুদ্ধটা শেষ হয়!

১ম পর্ব: ব্যাট্‌ল ফর সিরত, ২য় পর্ব: বিদ্রোহীদের কবলে, ৩য় পর্ব: গন্তব্য অজানা, ৪র্থ পর্ব: নরকে প্রত্যাবর্তন, ৫ম পর্ব: মৃত্যুর প্রতীক্ষায়, ৬ষ্ঠ পর্ব: দ্বিতীয় জীবন, ৭ম পর্ব: বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে, ৮ম পর্ব: প্রতীক্ষিত পুনর্মিলন

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *