লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (৪র্থ পর্ব): নরকে প্রত্যাবর্তন

আশরিনে আমাদের দিনগুলো মোটামুটি ভালোই কাটছিল। প্রথম দিন আমাদেরকে বেশ ভালোই আপ্যায়ন করল। দুপুরে একটা খারুফ (ভেড়া) জবাই করে মাকরোনা দিয়ে খেতে দিলো। বিকেলে আবার খুবজা দিয়ে চা।

দিনের বেলাটা আমাদের ভালোই কাটল। বাসা থেকেই সমুদ্র দেখা যায়। বিকেলের দিকে বাচ্চাকাচ্চা সহ আমরা সবাই সমুদ্রে গেলাম। যুদ্ধের কোনো চিহ্নও এই এলাকাতে নেই। ন্যাটোর ফাইটারগুলোও এদিকে আসে না। শুধু অ্যাপাচি হেলিকপ্টারগুলো খুব নিচে দিয়ে ওড়ে, একেবারে পরিষ্কার দেখা যায়।

রাতের বেলা জেনারেটর চালানো হল, ফলে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পরে আমরা প্রথম টিভি দেখতে পারলাম। এমনিতে লিবিয়া যুদ্ধের ব্যাপারে আল-জাজিরা সব সময়ই বিদ্রোহীদের পক্ষে অতিরঞ্জিত এবং একপেশে সংবাদ পরিবেশন করত, কিন্তু সিরতের ব্যাপারে দেখি তেমন কিছুই বলল না। শুধু বলল যে বিদ্রোহীরা সিরতের পূর্বে অবস্থিত আবুহাদিও দখল করে ফেলেছে এবং সেখানে অবস্থিত লিবিয়ার সবচেয়ে বড় ক্যান্টমনেন্টটিও এখন বিদ্রোহীদের দখলে। তবে যুদ্ধ শুধু সিরতে না, একই সাথে বানিওয়ালিদ এবং সাবহাতেও চলছে।

এছাড়া আরেকটা মজার সংবাদ দেখলাম রাই টিভি থেকে। সেখানে বলা হচ্ছে সিরতের সাত তলা ভবনগুলোতে ন্যাটোর হামলায় নাকি ৪৮০ জন নিহত হয়েছে। সাত তলা ভবনের সংখ্যা মোট ছয়টি। প্রতিটিতে ১৫টি করে মোট ৯০টি ফ্ল্যাট। যদি গড়ে সবগুলো ফ্ল্যাটে ৫ জন করে থাকে, তাহলেও হয় ৪৫০ জন।

কিন্তু মাত্র একটি ভবন পুরো মাটির সাথে মিশে গেছে, বাকিগুলো আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনগুলো ছিল সামরিক চাকরিজীবীদের জন্য বরাদ্দ। আইয়াদ হোয়েদার, যে নিজেই সামরিক বিভাগে চাকরি করে, সে জানাল, যুদ্ধের শুরুতেই ন্যাটোর হামলার আশংকায় সবগুলো পরিবারকে ঐ ভবনগুলো থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এই মুহূর্তে সেখানে ছিল শুধু তাওয়ার্গা থেকে আসা যোদ্ধারা। তাদের সংখ্যা ৪৮০ তো দূরের কথা, ৫০ এর বেশি কোনক্রমেই হবে না।

পরের দিন সকালে কামালের চাচা ওমর শেগলুফদের বিশাল যৌথ পরিবারের সবাই আশরিনে এসে হাজির হলো। তারা সাবা কিলোতে ছিল এবং বেশ ভালো অবস্থাতেই ছিল। আগের দিন আমরা চলে আসার পরপরই বিদ্রোহীরা সাবা কিলোর প্রতিটা বাসায় যায় এবং ঘরে ঘরে অস্ত্র তল্লাশি করে। তবে তাদের ব্যবহার ছিল খুবই ভালো। গোলাগুলি তো দূরের কথা, কারো সাথে তারা উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলে নি। বরং সবাইকে জিজ্ঞেস করেছে কারো খাবার-দাবারের ঘাটতি আছে কি না, কোনো সাহায্য লাগবে কি না।

ওমর শেগলুফদের বাসায় যে গ্রুপটা গিয়েছিল, তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার তাদের পূর্বপরিচিত। তারা শেগলুফদের বাসায় দুপুরের খাবার খেয়েছে, অ্যান্টি এয়ারক্রাফট এবং মেশিনগান ফিট করা গাড়িগুলো দরজার সামনে থামিয়ে রেখেই। শেগলুফের নাতি-নাতনিরা সেসব গাড়ির উপর চড়ে খেলাধুলা পর্যন্ত করেছে।

কিন্তু আজ সকাল থেকেই গাদ্দাফি-বাহিনী সাবা কিলো এলাকাটা লক্ষ করে গ্র্যাড মিসাইল মারতে শুরু করে। তিনটা মিসাইল তাদের বাসার কাছাকাছি পড়ে। তার পরপরই শেগলুফরা এখানে চলে আসে। শেগলুফদের পরপরই হারাগা, বুসেফি এবং বু’আরাবিয়ারাও চলে আসে এখানে।

এত মানুষ দেখে বাড়ির মালিক মোহাম্মদ হাদিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। রাতে ঘুমানোর সময় দেখা গেল শুধু পুরুষদের সংখ্যাই ষাট-সত্তর জন। ভেতরে মহিলা এবং বাচ্চাকাচ্চা হিসেব করলে সব মিলিয়ে মোট দেড় থেকে দুশো মানুষ হবে। ঘুমানোর সময় দেখা গেল সবার জায়গা হচ্ছে না। কাজেই যাদের গাড়ি আছে তারা গাড়িতে গিয়ে ঘুমালো।

আশরিনে আমরা ছিলাম সর্বমোট পাঁচ দিন – রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকাল বেলা পূর্ব দিকের পঞ্চাশ কিলোমিটার থেকে আরো দুইটা পরিবার এসে মোহাম্মদ হাদিয়াদের এই বাসায় আশ্রয় নিলো। এদিকে তাদের খাবারও যাচ্ছে শেষ হয়ে। আর কতদিন এভাবে থাকতে হবে সেটাও কেউ জানে না।

কাজেই কামালরা সিদ্ধান্ত নিলো এখানে আর থাকার দরকার নেই। সবাই ভাগাভাগি হয়ে অন্যান্য জায়গায় গিয়ে উঠবে। কামাল তার পরিবার নিয়ে হয়তো রকম তালাতার দিকে কোথাও গিয়ে উঠবে। আর আতেফের পরিবার, হামজা, বুড়ি আর উলা গিয়ে মোহাম্মদের পরিবারের সাথে তার শ্বশুর বাড়িতে উঠবে। এটাও রকম তালাতায়, সিরতের একেবারে সেন্টারে।

সমস্যা হলো আমাদেরকে নিয়ে। আম্মু আর তিথিকে নিয়ে তাদের আপত্তি নেই, কিন্তু আমরা পুরুষরা গিয়ে তাদের সাথে উঠাতে মোহাম্মদের আপত্তি। এমনিতেই মানুষ অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে, তার উপর ঐ বাড়িতে আমরা অনেকটা বাইরের মানুষ।

শোনা যাচ্ছে সিরতের পশ্চিম দিকে, অর্থাৎ আমাদের বাসার দিকে গত তিন দিন ধরে কোনো যুদ্ধ হয় নি, বিদ্রোহীরা প্রচণ্ড গ্র্যাড আক্রমণের মুখে পিছু হটেছে। তাই আপাতত সেদিকটা কয়েকদিনের জন্য নিরাপদ। কাজেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আম্মুরা মোহাম্মদের স্ত্রী জয়নব, উলা আর বুড়ির সাথে জয়নবের বাবাদের বাড়িতে থাকবে, আর আমরা চেষ্টা করব বাসায় চলে যেতে। আমাদের সাথে যাবে হামজা।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রওনা হলাম আমরা। আম্মুরা জয়নবের বাবাদের বাড়ির সামনে নেমে গেল। আমরা হামজার গাড়িতে করে এগোতে লাগলাম। এলাকার ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে এগোতে গিয়ে হামজার একেবারে বারোটা বেজে গেল। কারণ বিদ্রোহীরা যেন এলাকার ভেতরে সহজে ঢুকতে না পারে, সেজন্য প্রতিটা অলিতে গলিতে ডিগার-এক্সক্যাভেটর ব্যবহার করে মাটি ফেলে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। প্রতিটা এলাকা থেকে বের হওয়ার মাত্র একটা করে পথ খোলা আছে।

রকম তালাতা থেকে বের হওয়ার পথে শামীম-শাওনদের বাসা পড়ে। হামজাকে এক মিনিটের জন্য গাড়ি থামাতে বলে আমি নেমে দৌড় দিলাম ওদের বাসার দিকে। ওদের বাসার কাছাকাছি তরিক সাওয়াওয়ার (সাওয়াওয়া রোড) মোড়ে গাদ্দাফি-বাহিনীর চার-পাঁচ জন সৈন্যের একটা অস্ত্রধারী দল পাহারা দিচ্ছিল। আমাকে দৌড়াতে দেখেই অস্ত্র উঁচিয়ে আমার দিকে ছুটে এলো তারা। অগত্যা আমাকে থেমে আইডি কার্ড দেখিয়ে ঘটনা ব্যাখ্যা করতে হলো। আর কথা না বাড়িয়ে ছেড়ে দিল গার্ডগুলো, কিন্তু আমি বুঝে গেলাম ভবিষ্যতে আরও সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। যুদ্ধগ্রস্ত দেশে দৌড়ানোর স্বাধীনতাও সীমিত!

শামীমরা কেউ বাসায় নেই, জুমার নামাজ পড়তে গেছে। শুধু ওদের মা সরকার ম্যাডাম বাসায় আছে। জানতে পারলাম ওদের বাসাটা শহরের একেবারে কেন্দ্রে হওয়ায় বিদ্রোহীদের গোলাগুলি এখনও এতো দূরে এসে পৌঁছতে পারেনি। এখনও মোটামুটি নিরাপদই আছে এলাকাটা। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম।

রকম তালাতা, রকম ওয়াহেদ পার হয়ে রকম এতনিনের কাছাকাছি আসামাত্রই দেখলাম গলিতে গলিতে গাদ্দাফির সৈন্যরা পজিশন নিয়ে আছে। বালির বস্তা স্তূপাকারে রেখে পেছনে মেশিনগান ফিট করে বসে আছে। মাকমাদাস সুপার মার্কেট পার হওয়ার পর আর মেইন রোড দিয়ে এগোতে পারলাম না। রোডব্লক দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। পাশের নিচু রাস্তা দিয়ে ঢুকে যেই মাত্র ইউ মার্কেটকে পাশ কাটিয়েছি, তখনই আবার বাধা পড়ল।

এবার গাদ্দাফির পক্ষের এক সৈন্য পথ আটকালো। হাতের রাইফেল গাড়ির দিকে তাক করে ধরে বলল, যে দিক থেকে এসেছ সে দিকে ফিরে যাও। সামনে যুদ্ধ শুরু হতে পারে, সামনে যেতে পারবে না। হামজা বুঝাতে চেষ্টা করল আমাদের যাওয়ার অন্য কোনো জায়গা নেই। বাসায় যেতেই হবে। অন্তত চাল-আটা আনার জন্য হলেও যেতে হবে। কিন্তু সৈন্যটা কোনো কথাই শুনল না।

হামজা শেষবারের মতো চেষ্টা করল। গাড়ি নিয়ে সৈন্যটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করল। সৈন্যটা সাথে সাথে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে রাইফেল লোড করে আমাদের দিকে তাক করে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ফিরে যেতে বলেছি। ফিরে যাও। তা না হলে দিলাম গুলি করে। উপায় না দেখে হামজা গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো।

বাসায় যেতে না পেরে আমরা আবার ফিরে এসে শামীমদের বাসার সামনে নেমে গেলাম। হামজা আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে জয়নবের বাবাদের বাড়িতে চলে গেল। শুক্রবার বিকেলটা আমাদের ভালোই কাটল । অনেকদিন পরে দুপুরে পেট ভরে ভাত খেলাম মুরগির মাংস দিয়ে। রকম তালাতার দিকে এখনও কিছু কিছু জায়গায় হঠাৎ হঠাৎ মুরগি এবং কিছু তরি-তরকারি পাওয়া যায়।

শুক্রবার পুরো দিন কোনো যুদ্ধ হল না। শামীমদের কাছ থেকে জানতে পারলাম আমরা আশরিনে যাওয়ার পরদিন থেকেই যুদ্ধ বন্ধ। শনিবার সকালে তাই আমরা ঘুম থেকে উঠে আরেকবার বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম গাড়ি হয়তো ঢুকতে দিচ্ছে না, হেঁটে গেলে হয়তো ঢুকতে দিতে পারে।

সকাল আটটার দিকে আমরা শামীমদের বাসা থেকে বের হলাম। রাস্তায় অর্ধেক যেতে না যেতেই হঠাৎ করে ন্যাটোর ওড়াউড়ি শুরু হয়ে গেল। হাইডলার এলাকার দিকে ন্যাটো পরপর ছয় সাতটা বোমা মারল। বেশিরভাগ দোকানপাট, যাদের বড় বড় গ্লাসের দেয়াল ছিল, সেগুলো আগেই বোমার কম্পনে অথবা গুলির আঘাতে ভেঙ্গে পড়ে গিয়েছিল। ছোটখাটো যে কাঁচগুলো অবশিষ্ট ছিল, ন্যাটোর বোমার কম্পনে সেগুলোও ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হলো। আমরা মাথা বাঁচানোর জন্য ফুটপাথ ছেড়ে ভেতরের রাস্তায় ঢুকে গেলাম।

গতকাল যে পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম, আজ তার আগেই আমাদের থেমে যেতে হলো। অন্য একজন যোদ্ধা গতকালের মতোই রাইফেল উঁচু করে আমাদের থামাল। বললাম আমাদের বাসা রকম এতনিনে। থাকার অন্য কোনো জায়গা নেই, এখন কোথায় যাব? গার্ড উত্তর দিল, সেটা আমি জানি না। কিন্তু সামনে যেতে পারবে না। ফিরে যাও। ঘরের কথা ভুলে যাও। ওটা এখন যুদ্ধক্ষেত্র।

ফিরে আসার সময় ভার্সিটিতে আমাদের সহপাঠী আকরামের সাথে দেখা করলাম। আকরামরা গাদ্দাফি কাবিলার, তার বড় ভাই যুদ্ধ করছে। তাই ভাবলাম সে হয়ত কোনো সাহায্য করতে পারে। কিন্তু সেও একই কথা বলল, ঘরের কথা ভুলে যাও। যদি টাকা পয়সা বা জরুরী কিছু আনতে হয়, তাহলে সন্ধ্যার পরে আমি দশ মিনিটের জন্য হয়ত যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারি, কিন্তু ওখানে থাকতে পারবে না। থাকার জায়গার বেশি সমস্যা হলে আমাদের বাসায় এসে উঠতে পার।

আকরামের সাথে কথা বলতে বলতেই দূর থেকে মর্টারের শব্দ আসতে লাগলো। দেরি না করে আমরা আবার শামীমদের বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম। বাসায় পৌঁছার সাথে সাথেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তবে আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম জাফরান বা রকম এতনিনের দিকে যুদ্ধ হচ্ছে না, হচ্ছে আবুহাদির দিকে।

সারাদিন যুদ্ধ চলল। বিকেলের দিকে রকম তালাতার দিকেও কিছু মিসাইল এসে পড়তে লাগলো। মাথার উপর দিয়ে মেশিনগানের গুলি শিস কেটে উড়ে যেতে লাগলো। আমরা সময় কাটানোর জন্য উঠানে বসে মনোপলি খেলছিলাম। দৌড়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেলাম।

সন্ধ্যার পরপরই যুদ্ধ থেমে গেল। কিন্তু সাথে সাথেই ন্যাটোর ওড়াউড়ি শুরু হয়ে গেল। আশেপাশেই বেশ কয়েকটা বোমা মারল ন্যাটো। পাশের বাসা থেকে প্লাস্টারের গুঁড়া খসে এসে শামীমদের উঠানের মধ্যে পড়ল। বিকেল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল, রাতে বৃষ্টি শুরু হলো। রাত তিনটার দিকে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। কারণ বৃষ্টির পানি ঘরের ছাদ চুইয়ে চুইয়ে আমাদের গায়ে এসে পড়ছে। সেই সাথে খুব কাছেই কোথাও থেকে গাদ্দাফি বাহিনী বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে মিসাইল মারছে।

পরদিন রবিবার সকালে ইউনিভার্সিটি থেকে পাঁচজন বাংলাদেশী ক্লিনার এলো শামীমদের বাসায়। তারা জানালো গতকাল ইউনিভার্সিটির সামনে তুমুল যুদ্ধ হয়েছে। বিদ্রোহীরা জাজিরাত আবুহাদি (আবুহাদির চত্বর), যেটা আমাদের ইউনিভার্সিটি এক কিলোমিটার দূরে, সেখানে অবস্থান নিয়ে আক্রমণ করছিল আর গাদ্দাফি-বাহিনী ইউনিভার্সিটির আড়াল থেকে তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ করছিল।

বাংলাদেশীরা সবাই অক্ষত আছে, কিন্তু ইউনিভার্সিটির অবস্থা শেষ। ন্যাটো বোমা মেরেছে ভার্সিটির হোটেলের উপর, যেখানে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র জমা করে রাখা হয়েছিল। আর বিদ্রোহীদের রকেট গিয়ে পড়েছে বিভিন্ন ভবনে, যার মধ্যে আমাদের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিনের অফিসও আছে।

আজ সকাল থেকে পুরো ইউনিভার্সিটি এলাকায় গাদ্দাফি-বাহিনীর কোন যোদ্ধা নেই। তাই তারা তাড়াতাড়ি পালিয়ে এসেছে। শামীমের আব্বা সরকার আঙ্কেল তাদেরকে নিয়ে বের হলো আপাতত থাকার জন্য একটা বাসা খুঁজে দেওয়ার জন্য। এদিনও সারাদিন যুদ্ধ চলল, সম্ভবত ইউনিভার্সিটি রোডেই।

পরদিন সোমবার বিকেলে আমি আর আব্বু প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্যে দিয়েও ঘর থেকে বের হলাম আশে পাশে কয়েকদিনের জন্য কোনো বাসা ভাড়া পাওয়া যায় কি না খুঁজে দেখতে। আরেকজনের বাসায় আর কতদিন থাকা যায়? বের হওয়ার সময় এলাকা মোটামুটি শান্তই ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখি রাস্তায় গাদ্দাফির যোদ্ধারা ছোটাছুটি করছে, যাদের অর্ধেকের মতোই কৃষ্ণাঙ্গ, সম্ভবত আফ্রিকান বংশোদ্ভূত।

যোদ্ধাদেরকে এড়িয়ে চলার জন্য আমরা শামীমদের বাসার চারটা গলি পেছনের একটা গলির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি সেখানে গাছপালায় ঢাকা একটা বাড়ি থেকে দলে দলে যোদ্ধারা ভারী মেশিনগান, আরপিজি, আর গুলির বেল্ট নিয়ে বের হচ্ছে। আমার ইচ্ছা ছিল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে চলে যাব, তাহলে হয়তো কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আব্বু এতগুলো সৈন্য দেখে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালো।

তাই দেখে একজন সৈন্য রাইফেল উঁচিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কোথায় থাকি, এখানে কী করছি। থাকার জায়গা নেই, তাই বাড়ি খুঁজছি – এটা জানাতেই সে ধমকে উঠে বলল, এটা বাড়ি খোঁজার সময়? গুলি খেতে না চাইলে তাড়াতাড়ি ভাগো। সৈন্যদের ভাব-ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছিল কিছু একটা ঘটছে – বাসায় ফেরার পর শামীমদের পাশের বাসার পুলিশের চাকরি করা লোকটা জানালো, বেনগাজির বিদ্রোহী যোদ্ধারা আশরিন দখল করে ফেলেছে। তারা এখন সাওয়াওয়ার দিকে এগোচ্ছে।

সোমবারে অবশ্য আর নতুন করে যুদ্ধ হলো না, কিন্তু ন্যাটো বেশ কয়েকটা বোমা মারল একেবারে আশেপাশেই। মঙ্গল এবং বুধবারটাও প্রায় একই রকম কাটল। সকাল এগারোটার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়, গাদ্দাফি-বাহিনী সামনের শা’বিয়া পার্ক থেকে এবং পেছনের গাছপালা ঢাকা বাড়িটা থেকে নিয়মিত প্রচণ্ড মিসাইল আক্রমণ করে, সেই শব্দে পুরো ঘরবাড়ি কেঁপে ওঠে।

মাঝে মাঝেই বিদ্রোহীদের রকেট আশেপাশে এসে পড়ে, আর মেশিনগানের গুলি ঘরের উপর দিয়ে শাঁই শাঁই শব্দে উড়ে যায়। পরিস্থিতি যখন বেশি খারাপ হয়, তখন কিছুক্ষণ “লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্‌ জালেমিন” পড়ি, এছাড়া বেশির ভাগ সময়ই আমরা মনোপলি খেলে আর গল্প করে সময় কাটাই। অবশ্য গল্প করার মতো বিষয় এখন একটাই – গাদ্দাফির পক্ষ আর বিপক্ষ।

১৫ই ফেব্রুয়ারি আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন প্রথমে আমি গাদ্দাফির পক্ষেই ছিলাম। সুন্দর একটা দেশ চলছে, খামোখা সেই দেশে অশান্তি সৃষ্টি করার দরকারটা কি? কিন্তু ১৭ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি যখন বেনগাজিতে খালি হাতে মিছিল করা মানুষের উপর মেশিনগানের গুলি চালানো হল, ২০ ফেব্রুয়ারি যখন মিসরাতায় খালি হাতে মিছিল করা মানুষের উপর আবারও গুলি করা হলো, তখন থেকেই আমি গাদ্দাফির বিপক্ষে।

মূলত আন্দোলন শুরুর আগে লিবিয়ানদের মধ্যে গাদ্দাফির যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ছিল। গাদ্দাফি যদি আন্দোলনের শুরুতেই ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন দিয়ে দিত, কোনো সন্দেহ নেই জনগণ গাদ্দাফিকেই আবার নির্বাচিত করত। কিন্তু গাদ্দাফি নির্মমভাবে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে যত মানুষ মেরেছে, গুণোত্তর হারে মানুষ তত গাদ্দাফির বিপক্ষে চলে গেছে।

শামীম-শাওনদের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য ভিন্ন। প্রথমদিকে যখন বিদ্রোহীরা একের পর এক শহর দখল করে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন তারা বিদ্রোহীদের পক্ষে ছিল। আমাদের তখন বিবিসি, সিএনএন আসত না, তাই ভার্সিটিতে ওদের মুখ থেকেই বিদ্রোহীদের অগ্রগতি এবং গাদ্দাফি-বাহিনীর অত্যাচার এবং মিডিয়াতে মিথ্যাচারের সংবাদগুলো পেতাম।

কিন্তু ন্যাটোর আক্রমণ শুরুর পর, এপ্রিল-মে-জুনের দিকে যখন বিদ্রোহীদের অগ্রগতি থেমে গেল এবং গাদ্দাফি-বাহিনী কিছু শহর পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হল, তখন শামীম-শাওনের সুর পাল্টে গেল। সিরতের গাদ্দাফি-সমর্থকদের মতোই তাদের কাছেও তখন গাদ্দাফি এক মহান নেতা, বিদ্রোহী লিবিয়ান বলতে কোনো জিনিস নেই, সবই আল-কায়েদা আর ইসরায়েলের ষড়যন্ত্র।

প্রতিদিন রাতে এসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেই শামীমদের বাসায় আমাদের সময় কাটতে লাগলো। এরমধ্যে একদিন পাশের বাসার আজিম আংকেল এলো শামীমদের বাসায়। তিনি আরেক কাঠি সরেস। তার মতে ফ্রেঞ্চ, কাতারি এবং ইমারাতি সেনাবাহিনী নাকি লিবিয়াতে ঢুকে পড়েছে! কিন্তু তিন বাহিনী মিলেও গাদ্দাফির সৈন্যদের সাথে পেরে উঠছে না! পারবে কীভাবে? পঁচানব্বই শতাংশ জনগণই তো গাদ্দাফির পক্ষে!

বুধবার রাতে আবার প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত শুরু হলো। রকম তালাতার সুয়েজ পাইপগুলোর অবস্থা এমনিতেই খারাপ ছিল, সারা রাতের বৃষ্টির পর সকালে উঠে দেখা গেল সুয়েজ লাইন জ্যাম হয়ে এই গলির সবগুলো বাসার টয়লেটে পানি উপচে উঠে আসছে। দুর্গন্ধে ঘরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল। আমরা জোহর এবং আসরের সময় প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্যে দিয়েও মসজিদে বাথরুম সেরে আসলাম।

মসজিদে যাওয়ার পথে আগের দিন রাতে ন্যাটো যেখানে বোমা মেরেছে, সেটা দেখতে পেলাম। একজন কর্নেলের বিলাসবহুল বাড়ি, একটা পাশ ভেঙ্গে গুড়াগুড়া হয়ে আছে। শামীমদের বাসার দুই গলি পেছনে বিদ্রোহীদের মারা মিসাইল পড়েছিল, সেটাও দেখতে পেলাম – বারান্দা ভেঙ্গে পড়ে আছে।

এতদিন গাদ্দাফি-বাহিনী যে মিসাইলগুলো মারত, সেগুলো মারার শব্দের দশ-পনের সেকেন্ড পরে পড়ার শব্দ কানে আসত। কিন্তু আজ দেখলাম মারার শব্দের প্রায় তিন-চার সেকেন্ডের মধ্যেই সেগুলো ফেটে যাচ্ছে। আশেপাশের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম বিদ্রোহীরা সাওয়াওয়ার শেষ মাথা পর্যন্ত চলে এসেছে। ওদিকে সি-পোর্ট এবং সমুদ্রের পাড়ে নতুন তৈরি করা চারতলা বিল্ডিংগুলোও নাকি বিদ্রোহীদের দখলে। দুই দিকই এখান থেকে তিন কিলোমিটারেরও কম দূরে।

বিকেলের দিকে আমি আর আব্বু গেলাম জয়নবের বাবাদের বাড়িতে আম্মুর সাথে দেখা করার জন্য। যাওয়ার সময় অবস্থা একটু শান্ত ছিল, কিন্তু ওখানে পৌঁছানোর পরপরই প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আম্মুসহ হামজা-আতেফের সাথে কথা বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আম্মুরা ওদের সাথেই থাকবে। কিন্তু আমরা পরদিন সকালে উঠে আরেকবার বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করব। যুদ্ধ এখন এদিকেই বেশি, ওদিকে বেশ কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ হচ্ছে না। যদি আমরা কয়দিন থেকে বুঝতে পারি যে ওদিকের পরিস্থিতি ভালো, তাহলে বাকি সবাই-ও হয়ত ফিরে আসবে।

কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আমরা ঘর থেকে বের হতে পারলাম না গোলাগুলির কারণে। ওদিকে সন্ধ্যাও হয়ে আসছে। কারেন্ট নেই, সন্ধ্যার পর বের হওয়া একেবারেই নিরাপদ না। অন্ধকারে স্নাইপাররা ভুল বুঝে গুলি করে ফেলতে পারে। তাই গোলাগুলির মধ্যেই আমরা বের হয়ে গেলাম। আশেপাশের বাড়ির লিবিয়ানরা, যারা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, চিৎকার করে দেয়াল ঘেঁষে দৌড়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যেতে বলতে লাগলো।

আব্বুর মেরুদণ্ডে একটা অপারেশন হয়েছিল, তাই ভালো করে দৌড়াতে পারে না। আমি আব্বুকে ধরে ধরে দৌড়িয়ে নিতে লাগলাম। বাড়িগুলোর উপর দিয়ে গুলি উড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আমাদের থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ মিটার দূরে একটা রকেট এসে পড়ল। ধোঁয়ার চারদিক ভরে গেল। আমরা দেখার জন্য না দাঁড়িয়ে আরো তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ফিরে এলাম। ঘরে এসে দেখি তালহা আর শাওন ভাইয়া, শামীম-শাওনের সাথে মসজিদ থেকে ফিরে এসেছে। জানতে পারলাম তাদেরকে নাকি একই সাথে মাগরিব এবং এশার নামাজ পড়িয়ে দিয়েছে। জরুরী অবস্থায় নাকি এরকম পড়ার নিয়ম আছে!

রাতের বেলা প্রচণ্ড দুর্গন্ধে আর মশার উৎপাতের মধ্যে আমরা ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। উপরে ন্যাটোর বিরামহীন ওড়াউড়ি, সেই সাথে মাথায় বিরামহীন দুশ্চিন্তা। আগামীকাল আবার বাসায় ফেরার চেষ্টা করতে হবে। কে জানে এবার ঢুকতে পারব কি না?

কে জানে আমাদের ঘরবাড়ির কী অবস্থা! সে দিকে কি যুদ্ধ হচ্ছে? এখন যদি নাও হয়, আমরা যাওয়ার পরে যদি শুরু হয়, তখন আবার বের হতে পারব তো? আম্মু আর তিথিকে ফেলে চলে যাচ্ছি, তাদের সাথে এই জীবনে আর দেখা হবে তো? এতসব ভাবতে ভাবতে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলাম আমরা।

১ম পর্ব: ব্যাট্‌ল ফর সিরত, ২য় পর্ব: বিদ্রোহীদের কবলে, ৩য় পর্ব: গন্তব্য অজানা, ৪র্থ পর্ব: নরকে প্রত্যাবর্তন, ৫ম পর্ব: মৃত্যুর প্রতীক্ষায়, ৬ষ্ঠ পর্ব: দ্বিতীয় জীবন, ৭ম পর্ব: বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে, ৮ম পর্ব: প্রতীক্ষিত পুনর্মিলন

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *