লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (২য় পর্ব): বিদ্রোহীদের কবলে

১৬ই সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। আগের দিন রাতের বেলা ছাড়াছাড়া ঘুম হয়েছিল, তবুও খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। নাস্তা করে এলাকাটা দেখতে বের হয়ে আবিষ্কার করলাম পুরো এলাকা ফাঁকা। রাতে রাতেই বেশির ভাগ মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।

মেইন রোডে গিয়ে দেখি রাস্তার দুপাশের গাছগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে উপড়ে পড়ে আছে। দুপাশের দোকানগুলোর দরজা, দেয়াল ভেঙ্গে রাস্তায় পড়ে আছে। কাঁচের টুকরার জন্য রাস্তায় হাঁটা যাচ্ছে না। এলাকার প্রায় প্রতিটা দোতলা-তিনতলা বাড়ির দেয়ালে কয়েকটা করে গুলির ছিদ্র। আশেপাশের বাঙ্গালিদের বাসায় গিয়েও একটু খোঁজ-খবর নিলাম। সৌরভরা, মুক্তারা, হিরণ ভাইরা – সবাই-ই ভালো আছে।

ঘরে ফিরে এসে গোসল-টোসল সেরে যখন মাত্র ভাবছি আজ জুমার নামাজ পড়তে যাওয়া উচিত হবে কি না, তখনই আবার ধুপ-ধাপ শব্দ শুরু হয়ে গেল। বাড়িওয়ালা কামালের বোন উলা জানালা দিয়ে চিৎকার করে বলল, বিদ্রোহীরা ১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত এসে গেছে। আম্মু তাড়াতাড়ি মাটির চুলায় রান্না চাপিয়ে দিলো, যেন গোলাগুলি শুরু হলে ঘরের বাইরে থাকা না লাগে।

আধঘণ্টা না পেরুতেই শব্দ আরো জোরালো হয়ে উঠল। কামালের ভাই আতেফ এসে বলল তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হতে। এলাকায় কোন লিবিয়ান নেই। বিদ্রোহীরা যদি এলাকায় ঢুকে পড়ে তাহলে সর্বনাশ। পুরুষদেরকে ধরে ধরে জবাই করবে আর মহিলাদেরকে ধরে নিয়ে যাবে। কাজেই এলাকায় থাকা যাবে না, অন্য কোথাও যেতে হবে। আব্বু জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবে, উত্তরে আতেফ বলল সে জানে না। আগে গাড়িতে উঠা যাক, এরপর দেখা যাবে। কিন্তু ঘরে থাকা যাবে না।

লিবিয়ান প্রচার মাধ্যম যুদ্ধের শুরু থেকেই প্রচার করে আসছিল, বিদ্রোহীরা মানুষ জবাই করে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে, নারী নির্যাতন করে। এমনকি মার্চ-এপ্রিলের দিকে মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা কয়েকটা ভিডিওতে একজনকে জবাই করে পুরো গলা আলাদা করে ফেলছে এবং অপর একজনের কলিজা বের করে ফেলছে – এরকম দৃশ্য দেখাও গেছে।

কিন্তু সব বিদ্রোহীই অমানুষ – এটা আমি কখনোই বিশ্বাস করিনি। একেবারে প্রথম দিকে যখন বিদ্রোহ শুরু হয় তখন স্বভাবতই গুণ্ডা-বদমাশরাও তাতে যোগ দিয়েছিল এবং আইন-শৃঙ্খলা না থাকার সুযোগে তারা কিছু অঘটনও ঘটিয়েছিল। কিন্তু গত ছয়-সাত মাসে বিদ্রোহীরা এনটিসির অধীনে কিছুটা হলেও সংগঠিত হয়েছে। তাছাড়া প্রথম যখন নির্যাতনগুলো ঘটে তখনও সেটা শুধুই বিদ্রোহ ছিল, কিন্তু এখন পুরোমাত্রায় যুদ্ধ। কাজেই বিদ্রোহীরা এসে শহর দখল না করে লুটপাট, খুন-খারাপি আর নারী-নির্যাতন করবে – এটা আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না।

কিন্তু নিজেদের জীবন নিয়ে কথা। তাই আতেফের সাথে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। আব্বুর ঘর ছাড়ার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমি শুধুমাত্র আম্মু এবং ছোটবোন বোন তিথির কথা চিন্তা করেই জোর করে সবাইকে রাজি করালাম। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, গতকাল ঠিক আমাদের বাসার সামনে থেকে যেভাবে আরপিজি মেরেছে, আজও যদি সেভাবে মারে, তাহলে বিরোধীরা শিওর আমাদের বাসা লক্ষ্য করে মিসাইল মারবে। আর ভাগ্য যদি আরও খারাপ হয়, তাহলে ন্যাটোও মেরে বসতে পারে।

আতেফের চেঁচামেচি আর তাড়াহুড়ায় আমরা দুপুরের খাবার না খেয়েই, কোনো রকম জামাকাপড় না নিয়ে শুধুমাত্র পাসপোর্ট, কাগজপত্র এবং কিছু টাকাপয়সা ও স্বর্ণ-গয়না যে ব্যাগে ভরা ছিল, সেই ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দুটো গাড়ি তৈরি হলো। একটা আতেফের ভলভো – সেটাতে আতেফ, উলা আর আতেফের স্ত্রী মাবরুকা। অন্যটা টয়োটা পিকআপ। চালাবে মোত্তালেব, পাশের সিটে আব্বু, পেছনের সিটে আম্মু, তিথি আর মোত্তালেব-আতেফের মা হালিমা বুড়ি।

পেছনের খোলা জায়গায় মালপত্র, খাবার-দাবার, তার সাথে উঠলাম আমি, তালহা, খালাতো ভাই শাওন, প্রতিবেশী একজন মিসরীয় বৃদ্ধ এবং একজন মৌরতানিয়ান মাঝ বয়সী লোক। কালাশনিকভ রাইফেল নেওয়া হলো চারটা, গুলি নেওয়া হলো এক বালতি। রাইফেল একটা আতেফের গাড়িতে, একটা মোত্তালেবের সাথে, একটা আম্মুদের সিটের নিচে আর একটা নিল মৌরতানিয়ান লোকটা। সে বলল তার নাকি সামরিক ট্রেনিং আছে, প্রয়োজনে সে চালাতে পারবে।

আমার প্রথম থেকেই ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছিল না। কারণ লিবিয়ার যুদ্ধে গাদ্দাফি প্রথম থেকেই তার পক্ষে আফ্রিকান মার্সেনারিদেরকে ব্যবহার করে আসছিল। কারণটা খুবই সহজ – লিবিয়ান সৈন্যদেরকে বিদ্রোহীদের দমন করতে পাঠালে তারা যদি গিয়ে দেখে বিদ্রোহীরা হচ্ছে তাদেরই কবিলার (গোত্রের) লোক, তাহলে তারা সাইড চেঞ্জ করে ফেলতে পারে। কিন্তু মার্সেনারিদের ক্ষেত্রে সেরকম কিছু ঘটবে না।

আর তাই বিদ্রোহীরা এই মার্সেনারিদের উপরেই সবচেয়ে বেশি ক্ষ্যাপা। তাদেরকে পেলেই নির্বিচারে গুলি করে মারে। তবে বাস্তবে মার্সেনারির সংখ্যা যতটা না বেশি, তার চেয়ে বেশি ছিল এ বিষয়ক প্রচারণা। শোনা যায় বিদ্রোহীরা কোনো এলাকা দখলের পর সেখানে নিরীহ কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদেরকে পেলে তাদের হাতেও অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে বলে, বল্ তোরা গাদ্দাফির ভাড়াটে সৈন্য। এরপর সেই দৃশ্য ভিডিও করে মিডিয়াতে প্রচার করে।

আমাদের বাসা (১) থেকে নীল তীর চিহ্নিত পথ ধরে আমরা পালাচ্ছিলাম। (৫) নম্বর স্থানে আমরা বিদ্রোহীদের হাতে ধরা খাই।

যাই হোক, আমরা যাত্রা শুরু করার সময়ই দেখতে পেলাম আমাদের এলাকার ভেতরে জায়গায় জায়গায় পাঁচ-ছয়জন করে যোদ্ধারা হেঁটে হেঁটে পজিশন নেওয়ার মতো উপযুক্ত জায়গা খুঁজছে। প্রায় সবার হাতেই কালাশনিকভ রাইফেল এবং পিঠে রকেট লঞ্চার।

গলি থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ি শহরের বাইরে পশ্চিম দিকে সাবা কিলো (মানচিত্রে ৬ চিহ্নিত) নামক এলাকার দিকে যেতে লাগলো। ওদিক থেকেই বিদ্রোহীরা আক্রমণ করবে, কিন্তু ওদিকে কিছু মাজরা (ফার্ম) আছে, সেখানে গিয়ে হয়তো আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। মেইন রোড দিয়ে এগুতো পারলাম না, সেখানে রোডব্লক। বিভিন্ন মানুষের মাজরার ভেতর দিয়ে অনেক ঘুরে ফিরে এগুতে লাগলাম। অবশেষে দূর থেকে একটা পাকা রাস্তা দেখা গেল যেটা পার হলেই আমরা কামালের শ্বশুরবাড়ির মাজরায় গিয়ে উঠতে পারব।

এতক্ষণ রাস্তায় একটা গাড়িও চোখে পড়েনি। কিন্তু এই প্রথম পাকা রাস্তাটার উপরে কয়েকটা যুদ্ধের গাড়ি (টয়োটা এবং মিতসুবিশী পিকআপ এবং আর্মি জীপ) চোখে পড়ল। মনে হলো সেগুলো টহল দিচ্ছে। আমরা ধরেই নিলাম এগুলো গাদ্দাফির সৈন্যদের গাড়ি। কারণ বিদ্রোহীরা এই পর্যন্ত আসলে আর কিছু না হোক অন্তত কিছু গোলাগুলি তো হতোই! তাছাড়া বিরোধীরা এতো ধীরে সুস্থে গাড়ি চালিয়ে টহল দেওয়ারও কথা না।

মাজরা থেকে উঠে আমরা যেই মুহূর্তে রাস্তাটা অতিক্রম করে অন্য পাশের মাজরায় যাব, ঠিক তখনই হঠাৎ করে প্রচণ্ড বেগে চারটা গাড়ি আমাদের পাশে চলে এলো এবং আমাদেরকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ওয়াজ্ঞেফ! ওয়াজ্ঞেফ! অর্থাৎ, থাম! থাম! গাড়িগুলোর দিকে তাকাতেই আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগলো। কারণ একটা গাড়ির পেছনে যেভাবে হেভি মেশিনগান ফিট করা এবং তার সামনে যেরকম পুরু লোহার পাতের ঢাল দেওয়া ছিল, সেটা শুধু আল-জাজিরাতে বিদ্রোহীদের গাড়িতেই দেখেছি। গাদ্দাফি-বাহিনীর কাছে কখনও দেখিনি।

মোত্তালেব গাড়ি থামাতে না থামাতেই গাড়ি চারটাও থেমে গেল এবং সেগুলো থেকে যোদ্ধারা নেমে দৌড়ে আমাদের দিকে আসতে লাগলো আর চিৎকার করে বলতে লাগলো, ইনজিল! হাইয়া, ইনজিল! খাল্লি শুফ ইয়াদাইকুম! অর্থাৎ, নাম! তাড়াতাড়ি নাম! হাতগুলো দেখতে দাও!

প্রত্যেকের হাতে রাইফেল, কয়েকজন সেগুলো লোড করে নিলো। ইয়ং বয়সী ফর্সা একটা ছেলে, যে দলটার নেতৃত্ব দিচ্ছিল, সে পকেট থেকে ৯.৫ মিলিমিটার পিস্তল বের করে সেটাও লোড করে নিলো। ততক্ষণে আমার চোখে পড়ে গেছে ফর্সা ছেলেটার মাথায় বিদ্রোহীদের পতাকার রংয়ের ক্যাপ এবং একটা পিকআপে বিরোধীদের পতাকা। অর্থাৎ আমরা বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ে গেছি!

আমার মনে হতে লাগলো এই বুঝি আমাদের জীবনের শেষ দিন। কারণ তখনও আমাদের পাশে সেই মৌরতানিয়ান লোকটা রাইফেলটা হাতে নিয়েই বসে আছে। সামান্য একটু ভুল বোঝাবুঝির কারণে এখন গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে। আর এতো কাছ থেকে গুলি মিস হওয়ার কোনই সম্ভাবনা নেই।

আমি তাড়াতাড়ি নেমে তালহা আর শাওন ভাইয়াকেও নামতে বললাম। ততক্ষণে বিদ্রোহীরা এসে মৌরতানিয়ান লোকটার কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে গেছে এবং মোত্তালেবের সাথে কথা কাটাকাটি শুরু করে দিয়েছে। আমি তালহা, আব্বু আর শাওন ভাইয়াকে আস্তে আস্তে বললাম, আমরা দুই হাত দূরে থাকি যেন ওরা বুঝতে পারে আমরা একটা ফ্যামিলি এবং আমরা অস্ত্রশস্ত্রের সাথে জড়িত না। কিন্তু আমার নিষেধ সত্ত্বেও তালহা গাধাটা বারবার সামনে গিয়ে বিদ্রোহীদের সাথে মোত্তালেবের তর্কাতর্কি শোনার চেষ্টা করছিল।

বিদ্রোহীরা মোত্তালেবের হাতের রাইফেলটা নিতে চাইল, কিন্তু মোত্তালেব সেটা দিতে রাজি হলো না। মোত্তালেব এমনিতে প্রথম থেকেই বিদ্রোহীদের সাপোর্টার, কিন্তু অস্ত্র কে হাতছাড়া করতে চায়? একজন মোত্তালেবকে জিজ্ঞেস করল, অস্ত্রের কার্ড আছে? কোথা থেকে অস্ত্র পেয়েছ? মোত্তালেব চালাকি করে উত্তর দিল, দেশের অস্ত্র। দেশ দিয়েছে। লোকটা তখন বলল, দেশ মানে কী? মোয়াম্মারের অস্ত্র? মোত্তালেব মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ।

লোকটা তখন বলল, মোয়াম্মার? ওয়েন মোয়াম্মার? মোয়াম্মার হ্যাদা গেদিম, খালাস! তাউয়া মাজলেস। মাজলেস গাল এসলাহ মামনুয়া। খালাস, আতিনী এসলাহ।

অর্থাৎ, মোয়াম্মার? কোথায় মোয়াম্মার? সে তো পুরানো কাহিনী, শেষ! এখন কাউন্সিল ক্ষমতায়। কাউন্সিল বলেছে সাধারণ মানুষের কাছে অস্ত্র নিষিদ্ধ। ব্যাস, অস্ত্র দিয়ে দাও।

মোত্তালেব তারপরেও বাড়াবাড়ি করতে লাগলো। তখন একজন যোদ্ধা তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, ইয়া খুইয়া, আতিনী এসলাহ, ওয়া ওয়েন তিব্বী, এমশি। মা’ক আ’ইলা, মানিশ কাল্লেম হাজা। অর্থাৎ, ভাই, অস্ত্র দিয়ে দাও, এরপর কোথায় যেতে যাও, যাও। তোমাদের সাথে ফ্যামিলি আছে, আমরা কিচ্ছু বলব না।

একজন যোদ্ধা আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথাকার? বললাম, বাংলাদেশী। সে থাম্বস আপ দেখিয়ে বলল, ভালো। আরেকজন পিকআপের পেছনে মালপত্রের মধ্যে একনজর তাকিয়েই একটা বালতি তুলে নিলো। সেই বালতিতেই গুলি ভরা ছিল। গাড়ির ভেতরেও হয়তো তার চেক করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু উঁকি দিয়ে যখন দেখল ভেতরে মহিলা, তখন আর চেক করল না। শুধু হাত উঁচু করে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, মাতখাফ্‌শ, মাতখাফ্‌শ। অর্থাৎ, ভয় পেও না, ভয় পেও না।

এই চরম পরিস্থিতির মধ্যেও তালহা কয়েকবার আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে ফেলল, বিদ্রোহীরা কী ভালো, তাই না? আসলেই! আমিও বিদ্রোহীদের ব্যবহারে অবাক না হয়ে পারলাম না। গত ছয়-সাত মাস ধরে লিবিয়ান টিভিতে আর সিরতের লিবিয়ানদের মুখে বিদ্রোহীদের সম্পর্কে যেসব ভয়ংকর কাহিনী শুনেছি, তার সাথে কোন মিলই নেই। যাদের কাছে গাদ্দাফির দেওয়া অস্ত্র পাওয়া গেছে, যাদের সাথে অস্ত্রধারী মৌরতানিয়ান আছে, তাদের সাথে কাঁধের উপর হাত দিয়ে, ভাই সম্বোধন করে, এতো ভদ্রভাবে কথা বলা কোনো বিদ্রোহী গ্রুপের কাছ থেকে আশা করা যায় – এটা আমার কল্পনাতেও ছিল না।

মোত্তালেবের সাথে তর্কাতর্কি হয়তো আরও কিছুক্ষণ চলত, কিন্তু এমন সময় হঠাৎ আশেপাশে কোথাও একটা শেল এসে পড়ল। তার প্রায় সাথে সাথেই একের পর এক গুলি এসে আশেপাশের গাছে এবং ল্যাম্প পোস্টের উপরের দিকে বাড়ি খেতে লাগল। দুইজন বিদ্রোহী যোদ্ধা একটা গাছের আড়ালে পজিশন নিয়ে কান ফাটানো শব্দে ফায়ার করতে শুরু করল। আর আমাদেরকে ঘিরে থাকা যোদ্ধারা বলতে লাগলো, যাও ভাগো। তাড়াতাড়ি পালাও, সাবধানে যেও। মিসাইল এসে পড়তে পারে।

মোত্তালেবও এবার রাইফেলটা ছেড়ে দিল। গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিয়ে সে গাড়িটা ছেড়ে দিলো, পিছনে কে উঠতে পেরেছে সেটা না দেখেই। সবাই অবশ্য উঠে পড়েছে, আমি শুধু তালহাকে উঠিয়ে দিতে গিয়ে দেরি করে ফেললাম। গাড়ি ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। আমি সকল নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে দৌড়ে এসে একটা লাফ দিয়ে পুরো শরীর নিয়ে একসাথে পিকআপটার পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

পা’টা পড়ল একেবারে বেকায়দা ভাবে। হয়তো মচকে গেছে, কিন্তু সেদিকে লক্ষ করার মতো অবস্থা তখন নেই। এবড়ো-থেবড়ো কাঁচা রাস্তা দিয়ে ঝড়ের বেগে গাড়ি চলছে, আর আমরা পিকআপের পেছনে সবাই মাথা নিচু করে শক্ত করে একজন আরেকজনকে ধরে বসে আছি। মাথার উপর দিয়ে, কানের পাশ দিয়ে শাঁই শাঁই করে শিস কাটার মতো শব্দ করে বুলেট উড়ে যাচ্ছে। এর আগে শুধু মাসুদ রানাতেই এরকম বর্ণনা পড়েছিলাম, নিজের জীবনে কখনো ঘটবে, সেটা কল্পনাও করিনি।

গাড়ি এসে থামল কামালের শ্বশুরবাড়ির মাজরায়। নেমে দেখি আম্মু, তিথি, উলা, মাবরুকা, বুড়ি সবার মুখ ফ্যাকাশে, চোখেমুখে কান্নাকান্না ভাব। যে বিদ্রোহীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এতো আয়োজন, ঘর থেকে বেরুতে না বেরুতেই সেই বিদ্রোহীদের হাতে পড়লে অবশ্য এরকমই হওয়ার কথা। একমাত্র মোত্তালেবের উল্লাস দেখার মতো। সে খুশি যে, বিদ্রোহীরা শহরে ঢুকে পড়েছে।

আতেফের চেহারার দিকে অবশ্য একেবারেই তাকানো যাচ্ছিলো না। সে মাথায় হাত দিয়ে এক কোনায় বসে রইল। আতেফ ছিল একেবারে খাঁটি গাদ্দাফির পক্ষে। বিদ্রোহীদের হাতে এভাবে ধরা খেয়ে সবগুলো অস্ত্র দিয়ে দিতে হবে, এটা সে কল্পনাও করেনি। অবশ্য সান্ত্বনার কথা একটাই, আম্মুদের সিটের নিচে যে রাইফেলটা ছিল, সেটা বেঁচে গেছে। বিদ্রোহীরা মহিলা দেখে গাড়ির ভেতরে চেক করেনি, তাই এটা দেখতে পায় নি।

বিদ্রোহীরা আসলে কেমন হয়, সেটা দেখার শখ অনেক দিন ধরেই ছিল। আজ সেটা পূরণ হলো, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা যে এরকম ভয়াবহ হবে, সেটা কে জানত? আমাদের ধারণা হলো, আমরা নিরাপদ স্থানে এসেছি, কিন্তু কামালের স্ত্রী মাস্তুরার ভাই ওমর আর মোস্তফা জানাল, বিদ্রোহীরা নাকি এখান থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে একটা মাজরায় ঘাঁটি তৈরি করেছে। কাজেই এই জায়গাও নিরাপদ না। বিরোধীরাও যেকোনো সময় তল্লাশি করতে আসতে পারে, অথবা গাদ্দাফি-বাহিনীও মিসাইল মারতে পারে। আমরা এক নতুন অপরিচিত জায়গায় বসে বসে আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

১ম পর্ব: ব্যাট্‌ল ফর সিরত, ২য় পর্ব: বিদ্রোহীদের কবলে, ৩য় পর্ব: গন্তব্য অজানা, ৪র্থ পর্ব: নরকে প্রত্যাবর্তন, ৫ম পর্ব: মৃত্যুর প্রতীক্ষায়, ৬ষ্ঠ পর্ব: দ্বিতীয় জীবন, ৭ম পর্ব: বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে, ৮ম পর্ব: প্রতীক্ষিত পুনর্মিলন

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *