লিবিয়া যেভাবে স্বাধীনতা লাভ করেছিল

লিবিয়া ছিল জাতিসংঘের রেজোল্যুশনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করা প্রথম জাতিরাষ্ট্র। এবং আজকের দিনটা ছিল লিবিয়ার স্বাধীনতা দিবস। ১৯৫১ সালের এই দিনে (২৪ ডিসেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে “ইউনাইটেড কিংডম অফ লিবিয়া”।

লিবিয়া ছিল ইতালির কলোনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সম্মুখভাগে থাকা সেনুসি আন্দোলনের আমির মোহাম্মদ ইদ্রিস ব্রিটিশদের পক্ষে অবস্থান নেন এই আশায় যে, ইতালিয়ানরা পরাজিত হলে লিবিয়া স্বাধীনতা কিংবা পারতপক্ষে স্বায়ত্তশাসন লাভ করবে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইউরোপিয়ানরা লিবিয়াকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার চেষ্টা করে।

দক্ষিণের ফেজ্জান (বর্তমান সাবহাসহ বিশাল এলাকা) প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নেয় ফরাসিরা, আর পূর্বাঞ্চলীয় প্রবেশ সাইরেনাইকা (বর্তমান বেনগাজি+ বিশাল এলাকা) এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ত্রিপোলিতানিয়ার (বর্তমান ত্রিপোলি+ বিশাল এলাকা) নিয়ন্ত্রণ নেয় ব্রিটিশরা। ত্রিপোলিতানিয়ার প্রতি অবশ্য ইতালিয়ানদেরও দৃষ্টি ছিল, যেহেতু তখনও প্রায় ৬৫ হাজার ইতালিয়ান সেখানে বসবাস করত।

১৯৪৯ সালে ইউরোপিয়ানরা নিজেদের মধ্যে একটা চুক্তি (Bevin-Sforza Plan) করে, যেখানে ফেজ্জানে ফরাসিদেরকে, সাইরেনাইকায় ব্রিটিশদেরকে এবং ত্রিপোলিতানিয়ায় ইতালিয়ানদেরকে ১০ বছরের জন্য ট্রাস্টিশীপ দেওয়া হয়। কিন্তু লিবিয়াজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে এবং আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিছু আরব রাষ্ট্র এর বিরোধিতা করলে তা বাতিল হয়ে যায়।

ব্রিটিশরা বুঝতে পারে, জোর করে ট্রাস্টিশীপ ধরে রাখার চেষ্টা করার পরিবর্তে স্বেচ্ছায় স্বাধীনতা দিয়ে নতুন সরকারের উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করাই বেশি লাভজনক। ফলে ১৯৪৯ সালে তারা সাইরেনাইকার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয় এবং ইদ্রিস আস-সেনুসিকে রাজা হিসেবে সমর্থন দেয়। রাজা ইদ্রিস স্বাধীন “সাইরেনাইকা ইমারাত”-এর ঘোষণা দেন।

সে বছরই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রেজোল্যুশন পাশ হয় যে, ১৯৫২ সালের আগেই লিবিয়াকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল লিবিয়াতে আসে এবং তারা লিবিয়ার বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলোচনা করে লিবিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যায়। সকল পক্ষ একমত হয়, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশকে একত্রিত করে লিবিয়ান রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এর রাজা হবেন সাইরেনাইকা ইমারাতের আমির, ইদ্রিস আস-সেনুসি।

অবশেষে নির্ধারিত তারিখের আগেই ১৯৫১ সালের ২৪শে ডিসেম্বর, রাজা ইদ্রিস তার বেনগাজির মানারা প্যালেস থেকে লিবিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জন্মলাভ করে এক কৃত্রিম রাষ্ট্র “ইউনাইটেড কিংডম অফ লিবিয়া”। কৃত্রিম এই কারণে, এর আগে কখনোই লিবিয়া নামে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। ইতালিয়ান আমলের শেষের দিকের কয়েক বছর ছাড়া লিবিয়ার তিনটা প্রদেশ কখনোই একক প্রশাসনের অধীনে ছিল না।

লিবিয়ার সংবিধান তৈরি হয় পশ্চিমাদের পরামর্শে ১২টি দেশের সংবিধান থেকে কপি-পেস্ট করে। তিনটা প্রদেশের সমন্বয়ে যে ফেডেরালিজমের সৃষ্টি হয়, সেটাও লিবিয়ানদের কাছে এক নতুন ধারণা ছিল। ব্রিটিশদের অনুকরণে যে রাজতন্ত্র লিবিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তার সাথেও লিবিয়ানরা কখনো পরিচিত ছিল না। শতশত বছর ধরে তাদের আনুগত্য ছিল কেবল নিজ নিজ গোত্রের প্রতি এবং প্রতীকী অর্থে মুসলিম বিশ্বের খলিফার প্রতি।

স্বাধীনতার সময় লিবিয়ার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ মিলিয়ন। কিন্তু ইতালিয়ানদের প্রায় অর্ধশত বছরের দুঃশাসনের পর দেশটার আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। এর মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ৩৫ ডলার, ইয়েমেন ছাড়া সমগ্র আরব বিশ্বের মধ্যে যা ছিল সর্বনিম্ন। এর জনসংখ্যার প্রায় ৯০ভাগই ছিল নিরক্ষর। পুরো লিবিয়াতে কোনো কলেজ-ইউনিভার্সিটি ছিল না। সমগ্র দেশে কলেজ গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ছিল হাতে গোণা, টাইম ম্যাগাজিনের রিপোর্ট অনুযায়ী মাত্র ১৬ জন, যাদের মধ্যে কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সার্ভেয়ার বা ফার্মাসিস্ট ছিল না।

ইদ্রিস লিবিয়ার রাজা হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু ব্রিটিশ এবং আমেরিকানদের অনুরোধে তাকেই লিবিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। এবং স্বাভাবিকভাবেই হত-দরিদ্র এই রাষ্ট্র চালাতে গিয়ে সাহায্যের জন্য ইদ্রিসকে সেই ব্রিটিশ আর আমেরিকানদের উপরেই নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়। সাহায্যের বিনিময়ে ইদ্রিস তাদেরকে লিবিয়াতে সেনাঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দেন। ত্রিপোলিতে প্রতিষ্ঠিত হয় আমেরিকার বাইরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মার্কিন বিমান ঘাঁটি, হুইলাস এয়ারবেস, বর্তমানে যা মিতিগা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট নামে পরিচিত। প্রথম এক দশক পর্যন্ত লিবিয়া ছিল মাথাপিছু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মার্কিন সাহায্য পাওয়া রাষ্ট্র।

লিবিয়া সম্পর্কে আমার সবগুলো লেখা পড়তে পারবেন এখান থেকে

লিবিয়ানরা স্বাধীন হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই স্বাধীনতা রক্ষা করার মতো সামর্থ্য তাদের ছিল না। এমনকি দেশের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে শক্ত কোনো বন্ধন ছিল না। কৃত্রিমভাবে বন্ধন সৃষ্টির জন্য ইদ্রিস প্রথমে দুইটা শহরকে রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন – পশ্চিমের ত্রিপোলি এবং পূর্বের বেনগাজি। কিছুদিন ত্রিপোলি রাজধানী থাকবে, কিছুদিন বেনগাজি।

পরবর্তীতে ইদ্রিস ফেডেরালিজমের বিলুপ্তি ঘটিয়ে লিবিয়াকে একত্রিত করেছিলেন। যদিও সে সময় ঐ সিদ্ধান্তটা অজনপ্রিয় ছিল, কিন্তু একসময় সেটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। তেলের আবিষ্কার এবং গাদ্দাফির অভ্যুত্থানপরবর্তী বৈপ্লবিক কর্মসূচী লিবিয়াকে অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্র থেকে রূপান্তরিত করেছিল অন্যতম ধনী এবং স্বাবলম্বী রাষ্ট্রে। কিন্তু কয়েক দশক পর এখন আবার প্রতীয়মান হচ্ছে, “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।”

যে মানারা প্যালেস থেকে রাজা ইদ্রিস স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, গৃহযুদ্ধে বেনগাজির বিশাল একটা অংশের পাশাপাশি সেটাও প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। যে ফেডেরালিজমের অবসান ঘটিয়ে লিবিয়া শক্তিশালী একক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে ফেডেরালিজম পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে বিভাজন এতো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, একক রাষ্ট্র হিসেবে লিবিয়া আরব কতদিন টিকে থাকতে পারবে, সেই আশঙ্কা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *