বাদশাহ ফয়সাল কেন পেট্রোডলার চালু করেছিলেন?

সৌদি বাদশাহ ফয়সাল কেন পেট্রোডলার চালু করেছিলেন, সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে ১৯৭৩ সালটার দিকে ফিরে তাকাতে হবে। সে বছরটা ছিল মুসলমানদের জন্য, বা অ্যাকচুয়ালি আরবদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বছর। এই বছর একইসাথে দুইটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটে। এর একটা অবশ্য আরেকটার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।

প্রথমত, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দীর্ঘ ২৫ বছর পর এই বছরই প্রথমবারের মতো আরবরা তাদের বিরুদ্ধে প্রথম সীমিত আকারে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়।

আর দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার সাহায্যের প্রতিবাদে তেল উৎপাদনকারী আরব রাষ্ট্রগুলো একত্রিত হয়ে তেলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়, দাম বাড়িয়ে দেয়, এবং আমেরিকার কাছে তেল বিক্রি করা বন্ধ করে দেয়।

সিদ্ধান্তটা সবগুলো আরব দেশ মিলেই নিয়েছিল। ইনফ্যাক্ট লিবিয়া এবং ইরাক ওপেকের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের একদিন আগে নিজেদের উদ্যোগেই আমেরিকার উপর তেল অবরোধ দিয়েছিল। কিন্তু তারপরেও সৌদি আরবই যেহেতু বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ, এবং ওপেকের মধ্যে সৌদি আরবের প্রভাবই যেহেতু সবচেয়ে বেশি, তাই ওপেকের সম্মিলিত সিদ্ধান্তটি সৌদি আরবের নেতৃত্বেই গৃহীত হয়।

বিস্তারিত দেখুন ইউটিউব ভিডিওতে:

তেল অবরোধ এবং এর ফলাফল

তাছাড়া সে সময় সৌদি আরবের ক্ষমতায় ছিলেন বাদশাহ ফয়সাল। অন্যান্য সৌদি বাদশাহর তুলনায় তিনি ছিলেন একেবারেই ভিন্ন। অত্যন্ত ধার্মিক, সৎ এবং বিচক্ষণ হিসেবে তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ফিলিস্তিনের জন্য ছিল তার অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল। যুদ্ধের আগেও তিনি বেশ কয়েকবার আমেরিকাকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, আমেরিকা যেন ইসরায়েলকে চাপ দেয়, দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমি ফেরত দেওয়ার জন্য। তিনি আমেরিকাকে সতর্ক করেছিলেন, আমেরিকা যদি ইসরায়েলের প্রতি সাহায্য অব্যাহত রাখে, তাহলে যুদ্ধ বেধে গেলে আমেরিকার সাথে সোদি আরবের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। কিন্তু আমেরিকা তার কথায় কর্ণপাত না করে যুদ্ধ শুরুর পর নতুন করে ইসরায়েলকে সাহায্য করায় তিনি তেল অবরোধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

এই সিদ্ধান্তের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। যুদ্ধের আগে তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি মাত্র ৩ ডলার। কিন্তু অবরোধের পর মাত্র কয়েকমাসের মাথায়ই সেটা পৌঁছে যায় ১২ ডলারে! অবরোধের ফলে আমেরিকার পথে বসার মতো অবস্থা হয়। তাদের পেট্রোল স্টেশনগুলোতে বিশাল ভিড় লেগে যায়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন নির্দেশ জারি করেন, বিজোড় সংখ্যার নাম্বার প্লেটের গাড়িগুলো বিজোড় তারিখে এবং জোড় সংখ্যার নাম্বার প্লেটের গাড়িগুলো জোড় তারিখে পেট্রোল স্টেশনে যেতে পারবে। এছাড়াও তেলের ব্যবহার সীমিত করার জন্য গাড়ির সর্বোচ্চ স্পীড লিমিট করে দেওয়া হয় এবং প্রতিটা গাড়িতে একবারে সর্বোচ্চ কত তেল ভরা যাবে, সেটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

এর বিপরীতে তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তেল উৎপাদনকারী আরব রাষ্ট্রগুলো রাতারাতি অকল্পনীয় সম্পদের মালিক হয়ে যায়। এর আগ পর্যন্ত তেলের দাম ছিল খুবই কম। সেই দাম নির্ধারিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে, ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর দ্বারা। সে সময় তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলো সেই মূল্য নিয়ে দরদাম করার মতো অবস্থায় ছিল না। ফলে বছরের পর বছর ধরে তেল বিক্রি করা সত্ত্বেও মূল্য কম হওয়ায় তারা গরীবই রয়ে গিয়েছিল।

১৯৭৩ সালের অবরোধের ফলে তেলের দাম বেড়ে গেলে প্রথমবারের মতো বিশ্বের অর্থনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তিত হতে শুরু করে। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আরব রাষ্ট্রগুলোর হাতে আসতে শুরু করে। জনগণের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে তারা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ পায়। ১৯৭৩ সালের আগের আরব বিশ্ব ছিল প্রধানত ধু-ধু মরুভূমি। অবরোধের পরেই মূলত আরব বিশ্বের চেহারা পাল্টাতে শুরু করে। বর্তমানে আমরা উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর যে উন্নত চেহারা দেখি, তার শুরুটা হয়েছিল এই অবরোধের পর থেকেই।

এখন, তেল অবরোধ দেওয়ার সময় আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রধান দাবি ছিল, আমেরিকাকে ইসরায়েলের অন্যায় যুদ্ধে সহযোগিতা বন্ধ করতে হবে, এবং ইসরায়েলকে ৬৭ সালের পূর্বের সীমানায় ফিরে যেতে বাধ্য করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অবরোধ দেওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায়, দৃশ্যত কোনো অর্জন ছাড়াই সৌদি আরবের নেতৃত্বে লিবিয়া বাদে বাকি সবগুলো আরব রাষ্ট্র অবরোধ উঠিয়ে নেয়।

শুধু তাই না, অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার পর সৌদি আরব আগের চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণে তেল উৎপাদন শুরু করে দাম স্বাভাবিক করে আনার চেষ্টা করে। এবং এর কিছুদিন পরে আরও এক ধাপ এগিয়ে তারা আমেরিকার সাথে এমন একটা চুক্তি করে, যা কার্যত আমেরিকাকে একক সুপার পাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করে।

তারা ঘোষণা করে, এখন থেকে তারা যেকোনো দেশের কাছে তেল বিক্রি করার সময় কেবলমাত্র মার্কিন ডলার ছাড়া অন্য কোনো মুদ্রা গ্রহণ করবে না। তাদের এই ঘোষণার মাধ্যমেই জন্ম হয় পেট্রোডলারের, যেই পেট্রোডলারের কারণেই বর্তমানে ডলারের, এবং সেই ডলারের নিয়ন্ত্রণকর্তা হিসেবে আমেরিকার এত ক্ষমতা!

পেট্রোডলারের ইতিহাস নিয়ে এবং এর ভবিষ্যত নিয়ে আমি আগের ভিডিওতে এবং আর্টিকেলে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই ভিডিওতে এবং আর্টিকেলে আমি মূলত আলোচনা করব সৌদি আরবের হঠাৎ করে তেল অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার এবং এরপর পেট্রোডলার চুক্তির কারণ নিয়ে।

গল্পগুলো সিরিয়ার মকআপ

আমার নতুন বই!!!

স্পাই স্টোরিজ ২: স্নায়ুযুদ্ধের সফলতম ডাবল এজেন্টের কাহিনি

অবিশ্বাস্য সত্য ঘটনা অবলম্বনে ননফিকশন স্পাই থ্রিলার। উচ্চপদস্থ এক ডাবল এজেন্টের কাছে ১৫ বছর ধরে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নাস্তানাবুদ হওয়ার কাহিনি।

৪০০ .০০

বইমেলায় থাকছে ৪৩৯ নম্বর (সতীর্থ প্রকাশনার) স্টলে। এছাড়াও পাবেন রকমারি ডট কমে (৩৫% ছাড়ে), প্রকাশনীর ফেসবুক পেজ (৩৫% ছাড়ে) এবং আপনার পছন্দের যেকোনো অনলাইন বুকশপে।

বিস্তারিত
Short PDF

বাদশাহ ফয়সাল এবং তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা

তেল অবরোধের ফলে সৌদি আরব নিজেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছিল। আমেরিকাকেও তারা চাপে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তেমন কোনো অর্জন ছাড়া, শুধু আমেরিকার মৌখিক প্রতিশ্রুতির উপর ভরসা করেই কেন তারা এত সুন্দর একটা সুযোগ নষ্ট করে অবরোধ উঠিয়ে নিলো? এবং এরপর তাড়াহুড়া করে পেট্রোডলার চুক্তি করে আমেরিকাকে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করল? বিশেষ করে বাদশাহ ফয়সালের মতো ধার্মিক একজন শাসক কেন এই কাজ করলেন?

তার আগে বলে রাখি, আলোচনাটা যদি ইন্টারেস্টিং মনে হয়, এবং এরকম আলোচনা আরও শুনতে চান, তাহলে একটি লাইক দিয়ে চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে রাখুন।

পেট্রোডলার চালুর ব্যাপারটা নিয়ে যখন কেউ আলোচনা করে, অধিকাংশ সময়ই দেখবেন তারা বাদশাহ ফয়সালকে পুরোপুরি বেনিফিট অফ ডাউট দেয়। তাদের অনেকেই দাবি করে, এটা বাদশাহ ফয়সালের একটা ভুল ছিল। তিনি এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। না বুঝেই সরল বিশ্বাসে তিনি এই চুক্তি করে ফেলেছিলেন। এবং এরপর তিনি যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে চুক্তিটি বাতিল করতে চান, তখনই সিআইএ তাকে হত্যা করে।

বাস্তবে এ ধরনের অনুমানের কোনো ভিত্তি নেই। বাদশাহ ফয়সাল মোটেও রাজনীতির মারপ্যাঁচ না বোঝা সহজ-সরল কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সৌদি বাদশাহদের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য, সবচেয়ে কর্মঠ, এবং সবচেয়ে বিচক্ষণ। তার বুদ্ধিমত্তার উপর তার বাবা বাদশহা আব্দুল আজিজের এতই আস্থা ছিল যে, মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তিনি তাকে প্রতিনিধি হিসেবে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সফরে পাঠিয়েছিলেন তাদের সাথে আলোচনা করে সৌদ পরিবারের জন্য স্বীকৃতি আদায় করে আনতে। এবং কিশোর ফয়সাল তাতে সফলও হয়েছিলেন।

এছাড়াও মাত্র ২৪ বছর বয়সে আব্দুল আজিজ তাকে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। এই পদ তিনি ধরে রেখেছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত। প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়েই তিনি নিজের অফিসে গিয়ে কাজ শুরু করতেন। কোনো কোনো দিন সেই কাজ শেষ হতে হতে মাঝরাত হয়ে যেত। তাকে বলাই হয় – উলেদা মালিকান, অর্থাৎ হি ওয়াজ বর্ন অ্যাজ এ কিং। তার জন্মই হয়েছে বাদশাহ হওয়ার জন্য।

বাইদ্যওয়ে, বর্ন এ কিং নামে একটা মুভি আছে বাদশাহ ফয়সালের জীবনী নিয়ে। মুভিটার ভিডিও রিভিউ দেখতে আগ্রহী হলে কমেন্টে জানাবেন প্লীজ। তাহলে একটা ভিডিও তৈরি করব।

যাইহোক, মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, বাদশাহ ফয়সাল বুঝতে না পেরে পেট্রোডলার চালু করেছিলেন, বা তাকে ভুল বোঝানো হয়েছিল – এই যুক্তি ধোপে টেকে না। তেল অবরোধ প্রত্যাহার করা এবং পেট্রোডলার চালু করা – দুটোই তিনি বুঝেসুঝেই করেছিলেন। কিন্তু কেন? ব্যাখ্যা করছি।

দেখেন, বাদশাহ ফয়সাল প্রচণ্ড ধার্মিক ছিলেন, সৎ ছিলেন, অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন, প্রচণ্ড ইসরায়েল-বিরোধী ছিলেন, মনেপ্রানে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাইতেন – এগুলো সবই সত্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তিনি ছিলেন সৌদি আরবের বাদশাহ। সৌদি আরবের, বা স্পেসিফিকভাবে বললে আল-সৌদ পরিবারের ইতিহাসটাই এরকম, সেখানে কারো পক্ষে আমেরিকা-বিরোধী হওয়া সম্ভব না। আমেরিকার সাথে সুসম্পর্ক না থাকলে আল-সৌদ রাজবংশের টিকে থাকাটাই কঠিন হবে।

বাদশাহ ফয়সালও আমেরিকা-বিরোধী ছিলেন না। তার সাথে আমেরিকার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। ইনফ্যাক্ট, বিচক্ষণ একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি সবসময়ই চেয়েছেন আমেরিকার সাথে আরও বেশি সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে।

কারণ সে সময়টা ছিল কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধের সময়। তখন আপনাকে হয় আমেরিকান ব্লকে থাকতে হবে, নাহয় সোভিয়েত ব্লকে থাকতে থাকতে হবে। এবং বাদশাহ ফয়সালের দৃষ্টিতে নাস্তিক, কমিউনিস্ট সোভিয়েতের তুলনায় আমেরিকা ছিল হাজার গুণে ভালো।

বাদশাহ ফয়সালের কমিউনিজম-ভীতি

বাদশাহ ফয়সালের স্ট্রেঞ্জ একটা বিশ্বাস ছিল। দুইটা জিনিসকে তিনি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতেন। একটা হচ্ছে জায়নিজম, এবং আরেকটা হচ্ছে কমিউনিজম। তিনি বিশ্বাস করতেন, এবং তিনি তার বক্তব্যেও বলেছেন, কমিউনিজম হচ্ছে জায়নিজমেরই একটা রূপ। আর ইসরায়েল হচ্ছে আমেরিকার না, বরং বলশেভিকদেরই একটা প্রজেক্ট, যেন তারা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।

খুবই স্ট্রেঞ্জ বিশ্বাস, কিন্তু এর পেছনে একটা কারণও ছিল। সেটা হচ্ছে, যে বিপুল সংখ্যক ইহুদী ফিলিস্তিনে এসে তাদের ভূমি দখল করে ইসরায়েল গড়ে তুলেছিল, তাদের একটা বড় অংশ এসেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। আর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময়ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে ইসরায়েলের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।

এছাড়াও নিরাপত্তার দিক থেকেও সৌদি আরবের আমেরিকার সাহায্য অপরিহার্য ছিল। সে সময় একের পর এক বিভিন্ন আরব দেশে সোভিয়েতপন্থী সামরিক অফিসাররা অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করে নিচ্ছিল। মিসর, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া – সবগুলো দেশে একে একে রাজা-বাদশহদের পতন ঘটে গিয়েছিল।

ইরাকে সোভিয়েতপন্থী সেনা কর্মকর্তারা অভ্যুত্থানের পর সেখানকার বাদশাহকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে সেটা টিভিতে প্রচার করেছিল। মিসরে গামাল আব্দুল নাসের প্রকাশ্যেই বাদশাহ ফয়সালের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছিল, তাকে উৎখাত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছিল। ইয়েমেনে কমিউনিস্টপন্থী অফিসারদের বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে মিসরের সাথে সৌদি আরব এক-প্রকার প্রক্সি ওয়ারে জড়িয়ে পড়েছিল। মিসরীয় বিমানবাহিনী সৌদি আরবের সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে বিমান হামলা করছিল।

ওদিকে জর্ডানের বাদশাহর বিরুদ্ধেও সেনা কর্মকর্তারা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল, শেষ মুহূর্তে সিআইএ গিয়ে বাদশাহকে রক্ষা করে। এই কাহিনীটা বেশ ইন্টারেস্টিং। এটা নিয়ে আমার একটা ভিডিও আছে, ডেসক্রিপশনে এবং উপরে লিঙ্ক দেওয়া আছে, ভিডিওর শেষেও লিঙ্ক দিয়ে দেওয়া হবে, ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন।

যাইহোক, ব্যাপারটা হচ্ছে সে সময় গামাল আব্দুল নাসেরের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে প্রতিটা আরব দেশে কমিউনিস্টপন্থী বিপ্লবীদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং রাজতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ছিল। এটা ছিল সৌদি আরবের জন্য, বা অ্যাকচুয়ালি আল-সৌদ রাজবংশের জন্য এক্সিসটেনশিয়াল থ্রেট।

১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যুর পর মিসর সৌদি আরবের পক্ষে আসে ঠিকই, কিন্তু নাসেরের তৈরি করে দিয়ে যাওয়া বিপ্লবী চেতনা তখনও সৌদি আরবের জন্য বিশাল হুমকি ছিল। ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য সে সময় বাদশাহ ফয়সাল একদিকে হাজার হাজার বামপন্থী, সেক্যুলার এবং অন্যদিকে কট্টর ইসলামপন্থীদেরকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। এবং বামপন্থীদের এই থ্রেট থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি সব সময়ই আমেরিকার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন।

আমার সবগুলো বই


মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার স্পাই স্টোরিজ বইয়ের প্রচ্ছদ
মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার স্পাই স্টোরিজ ২ বইয়ের প্রচ্ছদ
মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার গল্পগুলো সিরিয়ার বইয়ের প্রচ্ছদ

সৌদ রাজবংশকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থ যখন ফিলিস্তিনপ্রীতির চেয়েও বড়

তো এরকম পরিস্থিতিতে যখন আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আমেরিকা ইসারয়েলকে সহযোগিতা করে, তখন বাদশাহ ফয়সাল ইসরায়েলকে সাহায্য করার প্রতিবাদে আমেরিকার উপর তেল অবরোধ দেন ঠিকই, কিন্তু তিনি কখনোই চাননি আমেরিকার সাথে সৌদি আরবের সম্পর্কের অবনতি ঘটুক।

যেহেতু এর আগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে আরবদের কোনো পদক্ষেপ সফল হয়নি, তাই ৭৩ সালের তেল অবরোধের কারণে বাদশাহ ফয়সাল চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি তেল অবরোধ দিয়েছিলেন, বা তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন যে, আমাদের তেল বিক্রির টাকার দরকার নাই, প্রয়োজনে আমরা দুধ আর খেজুর খেয়ে থাকব – এই কাহিনীগুলো অনেক বেশি শোনা যায়।

কিন্তু সে সময়ের ওপেকের মিটিং বা আমেরিকার সাথে সৌদি আরবের মিটিংগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা পড়লে জানা যায়, বাহ্যিকভাবে তেল অবরোধ দেওয়ার পরেও সৌদি আরব তেলের দাম খুব বেশি বাড়ানোর পক্ষপাতী ছিল না। লিবিয়া, ইরাক এবং ইরান যেখানে তেলের দাম ১২ ডলার বা আরও বেশি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিল, সেখানে সৌদি আরব ওপেকের মিটিংগুলোতে তেলের দাম ৮ ডলারের বেশি না ওঠানোর পক্ষে জোরাজুরি করছিল।

ব্যাপারটা স্ট্রেঞ্জ না? তেলের দাম বাড়লে তো সৌদি আরবেরই লাভ। তাহলে তারা কেন সেটার বিরোধিতা করবে? সৌদি আরবের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করলেই আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। তেলের দাম কিছু পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে সৌদি আরবের লাভ, ঠিক আছে। কিন্তু যদি অনেক বেড়ে যায়, তাহলে? তাহলে সৌদি আরবের লাভ যতটুকু, ক্ষতি তার চেয়েও বেশি।

কেন? কারণ তেলের দাম বাড়তে থাকলে সৌদি আরব একা লাভবান হবে না। লিবিয়া, ইরাক, আলজেরিয়াসহ রাজতন্ত্রবিরোধী, কমিউনিস্টপন্থী দেশগুলোও লাভবান হতে থাকবে। সেই লাভের টাকা তারা ঢালতে থাকবে অন্যান্য আরব দেশে রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে বাথ পার্টি বা অন্য কোনো কমিউনিস্টপন্থী সেনা অফিসারদেরকে ক্ষমতায় আনার জন্য।

অন্যদিকে তেলের দাম যত বাড়তে থাকবে, ততই সৌদি আরবের মিত্র শক্তিগুলো – অর্থাৎ আমেরিকা এবং ইউরোপের অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকবে। তারা আর সৌদি আরবের বিপদে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে পারবে না। অর্থাৎ সৌদি রাজপরিবারের পতন তখন হয়ে উঠবে সময়ের ব্যাপার।

ঠিক এ কারণেই অন্তরের অন্তস্থল থেকে ইসরায়েলকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও, এবং মনেপ্রাণে জেরুজালেমকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখলেও সৌদি রাজপরিবারের টিকে থাকার স্বার্থের কথা চিন্তা করে বাদশাহ ফয়সাল আমেরিকার উপর তেল অবরোধ দিলেও সেটাকে খুব বেশি কার্যকর করার পক্ষপাতী ছিলেন না।

তাছাড়া এখানে আরও দুইটা ফ্যাক্টরও কাজ করছিল। প্রথমত, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধটা শুরু করেছিল সিরিয়া এবং মিসর। তারা কেউই প্রধান তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্র না। ফলে তেল অবরোধ থেকে তাদের নিজেদের সরাসরি খুব একটা লাভ হচ্ছিল। বরং তাদের তখন দরকার ছিল নিজেদের হারানো ভূমি ফেরত পাওয়ার জন্য আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সাথে আলোচনা শুরু করা। কাজেই তারা সৌদি বাদশাহকে চাপ দিচ্ছিল অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে আলোচনার পথ প্রশস্ত করার জন্য।

দ্বিতীয়ত, তেল অবরোধ আমেরিকার অর্থনীতিকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল, প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার উপদেষ্টাদেরকে সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রগুলো দখল করে নেওয়ার অপশন বিচরণ করার নির্দেশ দিয়েছিল। সৌদি আরব যদি অবরোধ না উঠাতো, তাহলে আমেরিকা হয়তো সেরকম কিছুই করতে বাধ্য হতো।

এসব কিছুই মিলিয়েই অবরোধের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায়, কার্যত কোনো অর্জন ছাড়াই, শুধু আমেরিকার আশ্বাসের উপর ভিত্তি করে সৌদি আরব তেল অবরোধ উঠিয়ে নেয়। একইসাথে আমেরিকা আরেকটা কাজ করে। সৌদি আরব এর আগে দীর্ঘদিন ধরেই আমেরিকাকে অনুরোধ করে আসছিল তাদের সাথে স্পেশাল সামরিক সহায়তা চুক্তি করার জন্য, যেন সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতা থাকা নিশ্চিত হয়। কিন্তু এর আগে আমেরিকা এরকম কোনো চুক্তিতে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি।

কিন্তু তেল অবরোধ দেওয়ার পর আমেরিকা সৌদি আরবের প্রকৃত শক্তি বুঝতে পারে। ফলে তারা সৌদি আরবের সাথে এই সামরিক সহায়তা চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা শুরু করে। এই আলোচনার ফলাফলই হলো পেট্রো-ডলার চুক্তি।

অর্থাৎ সৌদি আরব শুধুমাত্র মার্কিন ডলারেই তেল বিক্রি করবে, এরপর সেই ডলার দিয়ে মার্কিন ট্রেজারির বন্ড কিনবে, বা সোজা কথায় সেই ডলার আমেরিকাতে বিনিয়োগ করবে, আর বিনিময়ে আমেরিকা সৌদি আরবকে সব ধরনের সামরিক সহযোগিতা দিবে। যেকোনো কমিউনিস্টপন্থী আরব রাষ্ট্র যদি সৌদি আরব দখল করে নিতে চায়, বা সৌদি রাজপরিবারকে উৎখাত করতে চায়, আমেরিকা সর্বশক্তি দিয়ে সৌদি আরবকে রক্ষা করবে।

অর্থাৎ আমেরিকা তার অর্থনীতির নিশ্চয়তা পায়, আর সৌদি রাজপরিবার তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার নিশ্চয়তা পায়। উইন উইন সিচুয়েশন। মাঝখান থেকে চাপা পড়ে যায় ইসরায়েল প্রসঙ্গ। সে সময় যে সৌদি আরবের সাথে আমেরিকার এই চুক্তি হয়েছিল, এবং সৌদি আরব যে মার্কিন ট্রেজারির বন্ড কিনতে শুরু করেছিল, বাদশাহ ফয়সালের অনুরোধে আমেরিকা সেটা গোপন রেখেছিল। দীর্ঘ ৪০ বছর পর ব্লুমবার্গ নিউজের ফ্রিডম অফ ইনফরমেশন অ্যাক্ট রিকোয়েস্টের প্রেক্ষিতে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট এই তথ্য ফাঁস করে।

উপসংহার: বাদশাহ ফয়সাল কি ভালো ছিলেন, নাকি খারাপ?

এখন কথা হচ্ছে, তার মানে কি বাদশাহ ফয়সাল কি ভালো ছিলেন, নাকি খারাপ ছিলেন? এর উত্তর হচ্ছে, দুনিয়াতে আপনি ১০০% ভালো শাসকের খোঁজ পাবেন না। বাদশাহ ফয়সালও ১০০% ভালো ছিলেন না। কিন্তু সৌদি আরবের মতো রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থেকে যতটুকু সৎ, যতটুকু ভালো হওয়া যায়, তিনি তার পুরোটাই ছিলেন। তার সততার, তার ধার্মিকতার, তার উদারতার অনেক গল্প আছে। কিন্তু তারপরেও তিনি যা করেছেন, আল-সৌদ রাজবংশকে টিকিয়ে রাখতে এ ছাড়া তার আর উপায় ছিল না।

সৌদি আরব বিষয়ক সকল লেখা পড়ুন এখান থেকে

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

3 Comments

  1. ভাই লিখা গুলা কয়দিন ধরে পড়ছি বেশ ভাল লাগছে । অনেক গুছানো বেশ লেখা । আমি আর বেশ কিছু টপিক এ এমন লিখা আশা করছিলাম । অবে আপনার সাইটটা বেশ পুরনো থিমটা আপডেট করলে রিডিং এক্সপেরিয়েন্স আর ভাল হবে আশা করি !! এমন ইতিহাস বিষয়ক আরো লিখা লেখ আশ করছি !

  2. সত্যিই গোছানো লেখা। যদিও এটি ভিডিওর ট্রান্স স্ক্রীপ্ট হয়তো। তারপরও ভালো হয়েছে। অজানা একটা প্রশ্নের সমাধান পেলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *