কেমন হবে বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি? (প্রথম আলোয় প্রকাশিত)

মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই গণতন্ত্র নেই। কিন্তু তারপরেও প্রতি চার বছর পরপর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সাথে সাথে তাদের ভাগ্যও পরিবর্তিত হয়। ৪৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পরেও তাই প্রশ্ন উঠছে, তার এ বিজয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্য কতটুকু পরিবর্তিত হবে? তিনি কি ট্রাম্পের নীতির বিপরীতে গিয়ে ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটাবেন? ওবামার নীতিতে ফেরত গিয়ে ইরানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলবেন, একাধিক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আন্দোলনকে সমর্থন এবং সহায়তা দিয়ে নতুন নতুন গৃহযুদ্ধ সৃষ্টিতে অবদান রাখবেন? নাকি মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে তিনি অনুসরণ করবেন এই দুয়ের মাঝামাঝি কোনো নীতি?

দীর্ঘদিন ধরে একটি ধারণা প্রচলিত ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে দলেরই হোক, তাতে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো প্রভাব পড়ে না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিষ্কারভাবেই এ ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন। তার শাসনামলে তিনি এমন অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা দীর্ঘদিনের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিপরীত। এবং এ সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে নিয়েছেন কংগ্রেস, পেন্টাগন কিংবা সিআইএর পরামর্শের বিপরীতে গিয়ে, সম্পূর্ণ নিজস্ব বিচার-বিবেচনায়। জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির একটা বড় অংশ হবে ট্রাম্পের নেওয়া এসব পদক্ষেপ থেকে বেরিয়ে এসে পূর্বের অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করা। আর এটা সবচেয়ে প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হবে ইরানের ক্ষেত্রে।

বাইডেন তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে পরিষ্কারভাবেই বলেছেন, তিনি ইরানকে পুনরায় পারমাণবিক চুক্তির আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামার সময় করা পারমাণবিক চুক্তিটিকে (JCPOA) ডেমোক্র্যাট পার্টি তাদের অন্যতম অর্জন হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে ২০১৮ সালে সেই চুক্তি বাতিল করেন। তিনি পাল্টা ইরানের উপর নতুন করে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেন এবং যেসব রাষ্ট্র তা অমান্য করবে, তাদের উপরেও অবরোধ আরোপের হুমকি দেন।

তার এই পদক্ষেপের ফলে ইরানের সাথে আমেরিকার সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়ে পুনরায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্প শুরু করে এবং প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ২০১৯ সালে সৌদি আরবের একটি তেলক্ষেত্রে ড্রোন হামলা পরিচালনা করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে পাল্টা ইরানি কুদস ফোর্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে হত্যা করা হলে ইরানপন্থী মিলিশিয়ারা ইরাকে মার্কিন সেনাঘাঁটিতে ব্যাপক মিসাইল হামলা পরিচালনা করে।

ওবামার পথ ধরে জো বাইডেন আন্তরিকভাবেই ইরানের সাথে চলমান এই উত্তেজনা প্রশমিত করার চেষ্টা করবেন। তিনি চাইবেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে মিলে ইরানকে পুনরায় পারমাণবিক চুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে। কিন্তু কাজটা মোটেও সহজ হবে না। একবার চুক্তি ভঙ্গ করায় ইরানিরা এবার সহজে আমেরিকার মিষ্টি কথায় ভুলবে না। তারা পূর্বের চেয়েও কঠিন ছাড় দাবি করে বসবে, যা দেওয়া হয়তো বাইডেনের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাছাড়া ইরানের আগামী নির্বাচনে যদি রক্ষণশীলরা ক্ষমতায় আসে, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে, যেহেতু তাদের অনেকে প্রথমবারই পারমাণবিক চুক্তির বিরোধিতা করেছিল

ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের বাইডেনের এই প্রচেষ্টা সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট করবে সৌদি আরবকে। ওবামা প্রশাসন যখন প্রথমবার ইরানের সাথে চুক্তি করেছিল, তাতেই সৌদি আরব প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং দুই দেশের সম্পর্কে এক ধরনের শীতলতা সৃষ্টি হয়েছিল। সৌদি আরবের দৃষ্টিতে, শান্তিচুক্তির মাধ্যমে ইরানের উপর থেকে অবরোধ সরিয়ে নিলে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় এবং সেই সুযোগে সিরিয়া, ইরাক লেবানন এবং ইয়েমেনে প্রভাব বিস্তার করার আরও বেশি সুযোগ পায়, যা সৌদি আরবের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

মূলত ইরানের সাথে ওবামা প্রশাসনের সুসম্পর্কই সৌদি আরবকে বাধ্য করেছিল ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে। এখন বাইডেন পুনরায় ইরানের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করলেও সৌদি আরব তাতে ক্ষুব্ধ হবে, কিন্তু ২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসনের সাথে সম্পর্কের অবনতির কয়েকমাস পরেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে পড়ায় দুই দেশ যেরকম নতুন করে সম্পর্ক স্থাপনের এবং ইরান ও ইয়েমেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিল, এবার সেরকম কিছু ঘটার সুযোগ থাকছে না। ফলে সৌদি আরবের এবার বাইডেনের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময় তার জামাতা জ্যারেড কুশনারের সাথে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদে সৌদি আরব তাদের প্রতিটি অন্যায় পদক্ষেপে যেরকম আমেরিকার সমর্থন পেয়ে আসছিল, বাইডেনের আমলে তা ঘটবে না। বাইডেন অবশ্যই ক্ষমতায় এসেই সাংবাদিক জামাল খাশোগজি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে তুলে এনে প্রিন্স মোহাম্মদকে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি তুলবেন না, কিন্তু তার শাসনামলে যদি সৌদি আরব পুনরায় এরকম কোনো ঘটনা ঘটায়, তাহলে তিনি আর কিছু না হলেও শক্ত অবরোধ আরোপ করতে বাধ্য হবেন।

বাইডেন তার নির্বাচনী প্রচারণায় ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসনের এবং বেসামরিক জনগণ হত্যারও তীব্র সমালোচনা করেছেন। এবং তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন বন্ধ করবেন এবং সৌদি আরবের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু বাইডেনের অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তার এই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। ওবামার শাসনামলের শেষের দিকে সম্পর্কের অবনতির মধ্য দিয়েও বাইডেন সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যেই অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে ইয়েমেনের উপর বিমান হামলা করার কাজেই।

অবশ্য এবারের বাস্তবতা কিছুটা হলেও ভিন্ন। দীর্ঘ পাঁচ বছরের যুদ্ধের পর সৌদি আরব নিজেও এখন ক্লান্ত। ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবের অন্যতম প্রধান অংশীদার আরব আমিরাত ইতোমধ্যেই এই যুদ্ধ থেকে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছে। সৌদি আরবও এখন এই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার সহজ একটা পথ খুঁজছে। বাইডেন যদি আন্তরিক হন, তাহলে আলোচনার মাধ্যমেই ইয়েমেন যুদ্ধের অবসান ঘটানো তার পক্ষে সম্ভব।

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটের ক্ষেত্রে বাইডেন ছিলেন ট্রাম্পের নীতির প্রচণ্ড সমালোচক। কিন্তু বাস্তবে তিনি নিজেও এমন কিছুই করবেন না, যা ইসরায়েলের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যায়, তিনি ট্রাম্পের বিপরীতে গিয়ে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেম থেকে সরিয়ে পুনরায় তেল আবিবে নিয়ে আসবেন না। এবং অতীতের মতোই ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রাখলেও তিনি তাতে কোনো বাধা দিবেন না, বা ইসরায়েলের প্রতি সামরিক সাহায্য হ্রাস করবেন না।

বাইডেন নিজেকে একজন খ্রিস্টান জায়নবাদী হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্যোগে ইসরায়েলের সাথে একাধিক আরব রাষ্ট্রের শান্তিচুক্তির তিনি প্রশংসা করেছেন। এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতায় আসলে অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের সাথেও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য তিনি কাজ করবেন। কাজেই এসব দিক থেকে ট্রাম্পের সাথে বাইডেনের নীতির তেমন কোনো পার্থক্য থাকবে না।

কিন্তু ট্রাম্প যেরকম দ্বিরাষ্ট্র সমাধানকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছিলেন, গোলান মালভূমি, জর্ডান উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরের ৩০ শতাংশ ভূমি অ্যানেক্স করার ইসরায়েলি পরিকল্পনাকে সমর্থন দিয়েছিলেন, বাইডেন খুব সম্ভবত সেগুলোর বিরোধিতা করবেন। সেইসাথে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেরকম ফিলিস্তিনিদের প্রতি বার্ষিক ৬০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, ওয়াশিংটনে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের অফিস বন্ধ করে দিয়েছিলেন, বাইডেন খুব সম্ভবত সেগুলো পুনরায় চালু করবেন। তার এসব উদ্যোগের ফলে দীর্ঘমেয়াদী ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো সমাধান না হলেও আপাতত ফিলিস্তিনি জনগণ কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

ইরাক এবং আফগানিস্তানের ব্যাপারে বাইডেনের অবস্থান হবে কিছুটা বাস্তববাদী। ট্রাম্প সম্পূর্ণ সেনাবাহিনীকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বললেও বাস্তবসম্মত কারণেই শেষপর্যন্ত তা পারেননি। অন্যদিকে বাইডেন কখনোই সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার পক্ষে না। মার্কিন আধিপত্য বজায় রাজার স্বার্থে তিনি ইরাক, সিরিয়া এবং আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী রাখার পক্ষে। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো সঙ্কট সৃষ্টি না হলে নতুন করে বাড়তি সেনাবাহিনী সেখানে পাঠাতে তিনি রাজি হবেন না।

আফগানিস্তান থেকেও বাইডেন সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে রাজি হবেন না। কিন্তু ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন জেনারেলদের “সন্ত্রাসবিরোধী” অপারেশন জোরদার করার পরিকল্পনার বিরোধিতা করার ইতিহাস তার আছে। তাছাড়া ওবামার সময় তিনিও গোপনে তালেবানের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু করেছিলেন। কাজেই ট্রাম্পের সাথে শুরু হওয়া তালেবানের শান্তি আলোচনা থেকে তিনি হয়তো পুরোপুরি বেরিয়ে আসবেন না।

সিরিয়ার ব্যাপারে ট্রাম্প ছিলেন ওবামার চেয়েও কঠোর। তিনি বিমান হামলা এবং অবরোধের পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেনি। এবারের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে সিরিয়া প্রসঙ্গ প্রায় ছিল না বললেই চলে। সেখান থেকে ধারণা করা যায়, সিরিয়া নিয়ে দুই প্রেসিডেন্টের নীতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকবে না। বাইডেনও সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বজায় রাখবেন। কিন্তু পার্থক্য হবে, তিনি হয়তো পুনরায় কুর্দিদের প্রতি সহায়তা বৃদ্ধি করবেন।

তুরস্কের ব্যাপারেও বাইডেনের নীতি হবে কুর্দিদের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধির। বাইডেন পরিষ্কারভাবেই বলেছেন, তিনি চান বিরোধী দলগুলোকে সাহায্য করার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ মিসাইল ক্রয় করা নিয়ে আমেরিকার সাথে তুরস্কের আগে থেকেই দ্বন্দ্ব চলছিল। তাছাড়া তুরস্ক যেভাবে আশেপাশের বিভিন্ন দেশে নিজের প্রভাব বিস্তার করে চলছে, সেটাও আমেরিকা এবং ইসরায়েলের জন্য উদ্বেগের কারণ। এতদিন পর্যন্ত কেবলমাত্র এরদোয়ানের সাথে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কারণেই কংগ্রেস এ ব্যাপারে কিছু করতে পারেনি।

কিন্তু এটা আশা করা উচিত হবে না যে, বাইডেন এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তুরস্কে সামরিক অভিযান পরিচালনা করবেন। তুরস্ক ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র এবং অনেক দেশেই রাশিয়ার বিপরীতে তুরস্ক এবং আমেরিকার অবস্থান একই পক্ষে। বাইডেন যা করতে পারেন তা হচ্ছে তুরস্কের উপর বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আরোপ করে তুরস্কের অর্থনীতিকে আরো দুর্বল করে তোলা এবং সেইসাথে আশা করা যে তুরস্কের জনগণ একসময় রাস্তায় নেমে এসে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করবে।

মিশর এবং লিবিয়ার ব্যাপারে বাইডেনের সাথে ট্রাম্পের নীতির খুব বেশি পার্থক্য থাকবে না। ২০১২ সালে লিবিয়াতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মৃত্যুর পর থেকেই আমেরিকা লিবিয়া থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। মাঝখানে ২০১৯ সালে ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন লিবিয়ান বিদ্রোহী নেতা জেনারেল খালিফা হাফতারকে ত্রিপোলি দখলের যুদ্ধের ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু এর বাইরে ঐ যুদ্ধে আমেরিকার তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না।

বরং ওবামার সময় খালিফা হাফতার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে পুরো লিবিয়া দখল করার ব্যাপারে অনুমতি চেয়েও হতাশ হয়েছিলেন। তাছাড়া বাইডেন নিজে ২০১১ সালে লিবিয়ায় মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছিলেন। এখনও বাইডেন সম্ভবত সেই একই নীতি অনুসরণ করবেন। তিনি জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের প্রতিই সমর্থন ব্যক্ত করবেন এবং সম্ভবত জাতিসংঘের মিশনকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করবেন।

মিশরে যদিও প্রেসিডেন্ট সিসিকে ট্রাম্প তার “ফেভারিট ডিক্টেটর” বলে মন্তব্য করায় বাইডেন তার প্রচণ্ড সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবে বাইডেন নিজেও সিসির বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না। মিশরসহ অধিকাংশ একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বাইডেনের অবস্থান হবে মুখে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে গণমাধ্যমের সামনে নিজের ভাবমূর্তি ঠিক রাখা এবং সেইসাথে কিছু অ্যাকটিভিস্টকে জেল কিংবা মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষা করা। কিন্তু এর বাইরে তার আমলেও জনস্বার্থবিরোধী একনায়করা আগের মতোই বহাল তবিয়তে টিকে থাকবে।

এর বাইরে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র না, এরকম যেকোনো দেশে যদি আন্দোলন শুরু হয়, বাইডেনের আমেরিকা তাৎক্ষণিকভাবে সেই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাবে, সরকারকে পদত্যাগের জন্য চাপ দেবে। কিন্তু যদি আমেরকিার মিত্র কোনো রাষ্ট্রে আন্দোলন শুরু হয়, তাহলে সেখানে বাইডেন নীরবতা পালন করতেই বেশি পছন্দ করবেন। আর যদি প্রতি-বিপ্লব ঘটে, মিশরের ক্ষেত্রে ওবামা যা করেছিলেন, বাইডেনও সেরকম নীরবে তা মেনে নিবেন।

বাইডেনের শাসনামলে যদি দ্বিতীয় আরব বসন্ত সৃষ্টি হয়, তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবেই তাতে ট্রাম্পের তুলনায় অনেক বেশি সমর্থন দিবেন, কিন্তু একইসাথে তার সমর্থন হবে ওবামার তুলনায় অনেক কম। মধ্যপ্রাচ্য এখন আর আমেরিকার জন্য ২০১১ সালের মতো গুরুত্বপূর্ণ না। বাইডেনের এখন প্রথম অগ্রাধিকার হবে করোনা ভাইরাস এবং অভ্যন্তরীণ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও মধ্যপ্রাচ্যের স্থান হবে ইউরোপের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং দক্ষিণ চীন সাগরে নিজের উপস্থিতি জোরদার করার পরে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাইডেন ওবামার মতো অতিরিক্ত গণতন্ত্রায়নও চাইবেন না, আবার ট্রাম্পের মতো একনায়কদেরকে অতিরিক্ত ছাড়ও দিবেন না। তিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে সকল সৈন্য প্রত্যাহারও করে নিতে চাইবেন না, আবার নতুন সৈন্য পাঠিয়ে নতুন যুদ্ধে জড়াতেও চাইবেন না। ইসরায়েলকে তিনি ট্রাম্পের মতো পুরাপুরি ছাড়ও দিবেন না, আবার ওবামার শেষ সময়ের মতো ইসরায়েলি অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের বিল পাশ করতেও সাহায্য করবেন না। যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু না ঘটে, তাহলে বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্যনীতি হবে ওবামা এবং ট্রাম্পের মাঝামাঝি।

এই লেখাটির একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ কিছুটা সম্পাদিত আকারে দৈনিক প্রথম আলোর মতামত বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে। পড়তে পারবেন এখান থেকে। এছাড়া আমার প্রকাশিত অন্যান্য লেখা পাবেন এই লিঙ্কে

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *