হাশেমী রাজবংশ: উত্থান এবং বিস্তার

বর্তমান যে আরব বিশ্ব, তার প্রতিষ্ঠার মূলে আছে দুটি রাজবংশ – সৌদ রাজবংশ এবং হাশেমী রাজবংশ।

সৌদ রাজবংশ সম্পর্কে তো সবাই জানে, কিন্তু সৌদরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হাশেমী রাজবংশ ছিল সৌদদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান “সৌদি আরব” তো বটেই, সিরিয়া, থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত সমগ্র আরব ভূমিই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল।

হাশেমী রাজবংশের নামটা এসেছে হযরত মুহাম্মদ (স) এর প্র-পিতামহ “হাশেম”-এর নাম অনুসারে, যেহেতু তারা তার বংশধর। আরো নির্দিষ্টভাবে বললে তারা হযরত আলির (রা) পুত্র হযরত হাসান বিন আলি (রা) এর বংশধর। তবে বর্তমানে যে হাশেমী “রাজবংশ”, তার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ধরা হয় শেরিফ হুসেইন বিন আলিকে। তিনি হচ্ছেন বর্তমান জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহর দাদার দাদা।

শেরিফ হুসেইন বিন আলি ছিলেন মক্কার “শেরিফ” এবং আমির যার উপর মক্কার দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল। তিনি ছিলেন অটোমান খিলাফতের অধীনস্থ, সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত। কিন্তু অটোমানরা যখন দুর্বল হয়ে আসতে থাকে, তখন ব্রিটিশদের প্রলোভনে পড়ে তিনি সমগ্র আরব ভূমির বাদশাহ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।

অটোমান শাসনামলের শেষের দিকে ইয়াং টার্ক তথা তরুণ তুর্কিদের বিপ্লবের পর থেকে আরবদের সাথে তুর্কিদের মধ্য দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সে সময় অটোমানদেরকে পরাজিত করার লক্ষ্যে ব্রিটিশরা আরবদেরকে জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। তারা হুসেইনকে প্রতিশ্রুতি দেয়, অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করলে যুদ্ধ শেষে সমগ্র আরব ভূমির নিয়ন্ত্রণ আরবদের হাতে তথা হুসেইনের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

এই প্রলোভনে পা দিয়ে হুসেইন আরব বিদ্রোহের ডাক দেন। তার এবং তার ছেলেদের সহায়তায় ব্রিটিশরা আরব উপদ্বীপ এবং জর্ডানের বিভিন্ন এলাকায় অটোমানদেরকে পরাজিত করে। কিন্তু যুদ্ধের পর যখন ভাগ-বাটোয়ারার সময় হয়, তখন হুসেইন দেখতে পান, ব্রিটিশরা শুধু তার সাথেই গোপন চুক্তি করেনি।

তারা একইসাথে ফরাসিদের সাথে সাইক্স পিকো চুক্তি করেছিল সিরিয়াকে ফরাসিদের তুলে দেওয়ার জন্য, বেলফোর ঘোষণা দিয়েছিল ফিলিস্তিনের কিছু অংশে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করার জন্য, এবং আরেক আরব রাজবংশ সৌদদেরকেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আরব ভূমির কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। আর তার জন্য তারা রেখেছিল কেবল হেজাজ (মক্কা-মদিনা-সহ সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চল)।

হাশেমী রাজবংশের ফ্যামিলি ট্রি

হুসেইনের এক ছেলে ফয়সাল চেষ্টা করেন ব্রিটিশদের আগেই সিরিয়ায় গিয়ে স্বাধীন সিরিয়া প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এ উদ্দেশ্যে তিনি শিয়াদের সাথেও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কিছুটা সফল হন, কয়েক বছর সিরিয়াতে রাজত্বও করেন, কিন্তু এরপর ফরাসিরা তাকে উৎখাত করে “ম্যান্ডেট” শাসনের নামে নব্য উপনিবেশবাদ প্রতিষ্ঠা করে।

তিনি যখন পালিয়ে গিয়ে তার ভাই আব্দুল্লাহর সাথে মিলে ফরাসিদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন, তখন ব্রিটিশরা তাকে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ইরাকের রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। তিনি এবং তার মৃত্যুর পর তার ছেলে গাজি কয়েক বছর ইরাকে রাজত্ব করেন।

গাজির মৃত্যুর পর ইরাকের রাজা হন তার ছেলে দ্বিতীয় ফয়সাল। এবং ১৯৫৮ সালে জামাল আব্দুল নাসেরের দ্বারা অনুপ্রাণিত সেনা কর্মকর্তারা এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার পুরো বংশকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে।

হুসেইনের আরেক পুত্র আলি তার পিতার অবসরের পর হেজাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু নাজদ এলাকা থেকে উঠে আসা অপর রাজবংশ সৌদ তাদের উপর আক্রমণ করে। ততদিনে হুসেইন ব্রিটিশদের সিদ্ধান্ত না মেনে সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিনসহ সমগ্র আরব ভূমির স্বাধীনতার দাবিতে অনড় থাকায় তারা হুসেইনকে সাহায্য না করে ইবনে সৌদকে সাহায্য করে।

তাদের সহায়তায় ইবনে সৌদ হুসেইন এবং আলিকে পরাজিত করে, মক্কা-মদিনার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং নাজদ ও হেজাজকে একত্রিত করে আধুনিক “সৌদি আরব” প্রতিষ্ঠা করে। পরাজিত আলি দেশত্যাগ করেন। তার বংশধররা পরবর্তীতে ইউরোপ এবং আমেরিকায় স্থায়ী হয়।

হুসেইনের আরেক পুত্র আব্দুল্লাহ ট্রান্স-জর্ডানে গিয়ে স্থানীয়দের সমর্থন লাভ করেন এবং সেখানে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়, আব্দুল্লাহ তখন ইসরায়েলিদের সাথে গোপনে সমঝোতা করেন। তিনি জেরুজালেমসহ জর্ডান নদীর পূর্ব প্রান্তের বিশাল ভূমি নিজের অধীনে পাওয়ার বিনিময়ে বাকি অংশে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা মেনে নেন।

চার বছর পর ক্ষুব্ধ এক ফিলিস্তিনি আল-আকসা মসজিদে আব্দুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে। সে সময় তার পাশেই ছিলেন তার নাতি, কিশোর হুসেইন। তার শরীরেও গুলি লেগেছিল, কিন্তু পোশাকের ধাতব অংশে বাধা পাওয়ায় হুসেইন বেঁচে যান।

আব্দুল্লাহর মৃত্যুর পর প্রথমে রাজা হন তার পুত্র, এবং হুসেইনের বাবা, তালাল। কিন্তু তিনি ছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ। ফলে কয়েক বছর পর, ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার দিন তাকে সরিয়ে হুসেইন বিন তালালকে ক্ষমতায় বসানো হয়। হুসেইন পরবর্তী ৪৮ বছর জর্ডানের রাজত্ব করেন। ১৯৯৯ সালে তার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসেন তার পুত্র আব্দুল্লাহ, জর্ডানের বর্তমান বাদশাহ।

শেরিফ হুসেইন বিন আলির যতটুকু ক্ষমতা ছিল, তিনি তার চেয়ে অনেক বেশি স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ছিলেন শুধুমাত্র মক্কার গভর্নর। তার যতটুকু শক্তি ছিল, তাতে হতে পারতেন বড় জোর হেজাজের অধিপতি। অথচ তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন তুর্কিদেরকে সরিয়ে সমগ্র আরব ভূমির বাদশাহ হবেন। আর সেটা করতে গিয়ে তিনি সাহায্য করেছেন ব্রিটিশদেরকে। ফলে বাকি জীবন তাকে এবং তার বংশধরদেরকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থেকেই রাজ্য শাসন করতে হয়েছে।

আরও পড়ুন: প্রিন্সেস সারভাত: যে বাঙালি নারী হতে যাচ্ছিলেন জর্ডানের রানি!

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *