গাদ্দাফির শাসনামলের ১০টি অবিশ্বাস্য সুবিধা: কতটুকু বাস্তব, কতটুকু প্রপাগান্ডা?

মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফির গুণগান সম্বলিত একটি ভাইরাল লিস্ট পাওয়া যায় ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটে, যেখানে গাদ্দাফির শাসনামলে লিবিয়ানরা কত সুখে-শান্তিতে ছিল, সেটি বোঝানোর জন্য ১০টি বা ১২টি পয়েন্ট উল্লেখ করা হয়।

লিস্টটি অত্যন্ত জনপ্রিয়, দুদিন পরপরই কেউ না কেউ এটি শেয়ার করে, এবং অবধারিতভাবে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডদের কেউ না কেউ আমাকে সেখানে ট্যাগ করে এর সত্যতা জানতে চায়। অনেক দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত এর সত্যতা যাচাইমূলক একটি লেখা লিখেই ফেললাম।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কয়েকটা ব্যাপার ক্লিয়ার করি। লিবিয়াতে গাদ্দাফির শাসনামলে কোনো নিরপেক্ষ পত্রপত্রিকা ছিল না। কাজেই এই লেখার কোনো অথেনটিক রেফারেন্স দেওয়া কঠিন।

ইন্টারনেটে আরবি-ইংলিশে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। কিন্তু যতগুলো লেখা পেয়েছি, সবগুলোতে হয় গাদ্দাফির ভক্তরা সবগুলো পয়েন্টকে একবাক্যে সমর্থন জানিয়েছে, অথবা গাদ্দাফি বিরোধীরা সবগুলো পয়েন্টকে উড়িয়ে দিয়েছে। নিরপেক্ষ লেখা বলতে গেলে একটিও পাইনি।

আমি নিজে জন্মের পর থেকেই লিবিয়াতে আছি। কয়েকটি পয়েন্ট সম্পর্কে আমার ধারণা আছে, কিন্তু অধিকাংশ পয়েন্ট লিবিয়ানদের সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত হওয়ায় সেগুলো সম্পর্কে আমার পরিষ্কার ধারণা ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত আমি সরাসরি কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি।

এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য যাকে মনে হয়েছে, সে হচ্ছে বাংলাদেশ এম্বাসির পার্টটাইম লিবিয়ান ড্রাইভার, হোসেন। সে মূলত গাদ্দাফির সাপোর্টার, কিন্তু শিক্ষিত (প্রাইমারী স্কুলের গণিতের সিনিয়র শিক্ষক) এবং সচেতন হওয়ায় আবেগ-তাড়িত না হয়ে আমার সবগুলো প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়েছে।

আলোচনায় বারবার দিনারের প্রসঙ্গ উঠবে। দিনারের মান বিভিন্ন সময় বারবার উঠানামা করেছে। আমি এখানে গাদ্দাফির শাসনামলের শেষ কয়েক বছরের গড় মান হিসেবে ১ মার্কিন ডলার = ১.৪০ দিনার ধরেছি। অথবা ১ দিনার সমান সে সময়ের বাংলাদেশের ৫০ টাকাও ধরে নেওয়া যায়।

মূল দাবিগুলো ইন্টারনেটে বিভিন্ন সাইটে বিভিন্নভাবে এসেছে। অধিকাংশ লিস্টেই কমন পড়ে, এরকম ১২টি পয়েন্ট নিয়েছি আমি এখানে। এর বাইরেও যদি কোনো পয়েন্ট সম্পর্কে আপনার জানার ইচ্ছা থাকে, তাহলে কমেন্টে জিজ্ঞেস করতে পারেন। উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।

দাবি ১: গাদ্দাফির আমলে কোনো বিদ্যুৎ বিল দিতে হতো না, সবাই বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সুবিধা পেত

বাস্তবতা: সম্পূর্ণ মিথ্যা।

গাদ্দাফির শাসনামলে বিদ্যুৎ বিল অবশ্যই দিতে হতো, তবে বিলের পরিমাণ ছিল খুবই কম। গাদ্দাফির আমলের শেষের দিকে বিদ্যুৎ বিল ছিল সাধারণ বাসাবাড়ির জন্য কিলোওয়াট প্রতি ২ গ্যারেশ (২ পয়সা, অর্থাৎ বাংলাদেশের ১ টাকা)।

আমরা নিজেরাই বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছি। বাড়িতে মিটার বসানো থাকত, সেখান থেকে ব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমাণ জানা যেত। মাস শেষে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন এসে দরজার নিচ দিয়ে বিলের কাগজ দিয়ে যেত। এলাকাভেদে পরপর তিন/ছয় মাস বিল বাকি পড়লে এসে লাইন কেটে দিয়ে যেত। ২০০৬-০৭ সালেও ত্রিপোলিতে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকদেরকে লাইন কেটে দিতে দেখেছি।

তবে গাদ্দাফির আমলে লিবিয়াতে লোড শেডিং ছিল না। গাদ্দাফির পতনের পর ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তৃতি লাভ করায় লিবিয়ার বিদ্যুতের চাহিদাও অনেক বেড়ে যায়। আবার যুদ্ধে বিভিন্ন উৎপাদন কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে বিদ্যুতের উৎপাদনও অনেক হ্রাস পায়। ফলে গ্রীষ্ম কালে আট থেকে দশ ঘণ্টা পর্যন্ত লোড হওয়া শেডিং শুরু হয়।

এছাড়া গাদ্দাফির পতনের পর থেকে সবার হাতে হাতে অস্ত্র থাকায় বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষে অপরিশোধিত বিলের জন্য লাইন কেটে দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এখন আর কেউই বিল পরিশোধ করে না।। লোড শেডিংয়ের এটিও অন্যতম একটি কারণ।

দাবি ২: লিবিয়ায় শিক্ষা এবং চিকিৎসা সেবা বিনামূল্যে ছিল

বাস্তবতা: সত্য

ছিল বললে ভুল হবে, কারণ এখনও এসব সেবা বিনামূল্যেই আছে। কিন্তু গাদ্দাফির আমলের মতোই এখনও সেবার মান খুবই নিম্ন।

গাদ্দাফির আমলেও লিবিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বিভিন্ন সাইটে যে দাবি করা হয়, চিকিৎসা ব্যবস্থা মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার মধ্যে সেরা ছিল, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। লিবিয়ানদের যাদের কিছুটা সামর্থ্য ছিল, তারা চিকিৎসার জন্য প্রায়ই পার্শ্ববর্তী দেশ তিউনিসিয়ায় যেত। যাদের সেই সামর্থ্য ছিল না, তারা টাকা খরচ করে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে যেত।

প্রতিটি এলাকায় বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতাল ছিল এবং এখনও আছে, কিন্তু সেগুলোর সেবা খুবই নিম্নমানের, এবং সেখানকার ডিসপেনসারিতে অধিকাংশ ওষুধই পাওয়া যায় না। তবে গাদ্দাফির শাসনামলে বিভিন্ন অপারেশন, ডায়ালাইসিস – এগুলো প্রতিটি শহরের সেন্ট্রাল হসপিটাল থেকে লিবিয়ানরা বিনামূল্যে করাতে পারত।

গাদ্দাফির পতনের পর অবশ্য পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর বাজেট ঘাটতির কারণে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিনতে না পারায় এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লিবিয়া শিক্ষা ব্যবস্থাও বিনামূল্যে ছিল এবং এখনও আছে। কিন্তু সেই শিক্ষার মানও খুবই খারাপ। গাদ্দাফির শাসনামলে দীর্ঘ এক দশক লিবিয়াতে ইংরেজি শিক্ষা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। অথচ সেই একই সময়ে গাদ্দাফি এবং তার শিক্ষামন্ত্রীর ছেলেরা ঠিকই বিদেশে থেকে পড়াশোনা করেছিল। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরেও লিবিয়ান স্কুলগুলোতে ইংরেজি শেখানো শুরু করা হতো ক্লাস সেভেন থেকে।

দাবি ৩: লিবিয়ার কোনো নাগরিককে শিক্ষা গ্রহণ কিংবা চিকিৎসাসেবা নিতে বিদেশে যেতে হলে সরকার সব ব্যয় বহন করত

বাস্তবতা: আংশিক সত্য

গাদ্দাফির সময়ে ভালো ফলাফল করা ছাত্রছাত্রীদেরকে সরকারি খরচে পড়াশোনার জন্য বিদেশে পাঠানো হতো। তাদের মাসিক ভাতা বেশ আকর্ষণীয় ছিল। এবং সেটির লোভে অনেক ছাত্রই চার বছরের কোর্স শেষ করতে ছয়-সাত বছর লাগিয়ে দিত।

কিন্তু বিভিন্ন সাইটে যেরকম দাবি করা হয় লিবিয়ার ৮০ শতাংশ মানুষ উচ্চশিক্ষিত বা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমাদের আশেপাশের ২০-৩০ টা যৌথ পরিবারের মধ্যে মাত্র তিনজনের কথা জানতাম, যারা বিদেশে পড়াশোনা করত।

চিকিৎসার ব্যাপারটা সত্য, দেশে চিকিৎসা না থাকলে সরকারিভাবে বিদেশে পাঠানোর নিয়ম ছিল। কিন্তু যেভাবে দাবি করা হয় যে, যেকোনো নাগরিকই চাওয়া-মাত্র সুযোগটা পেত, সেটি সত্য না। কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে, রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের ভালো কানেকশন থাকলে, সরকারী ডাক্তারের রিকমেন্ডেশন পেলে বিদেশে চিকিৎসার খরচ সরকার বহন করত।

দাবি ৪: লিবিয়ায় ব্যাংক ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এবং সুদমুক্ত, লোন নিলে কোনো সুদ পরিশোধ করতে হতো না

বাস্তবতা: সম্পূর্ণ মিথ্যা

গাদ্দাফির সময়েও ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদ দিতে হতো। যদিও সুদের পরিমাণ ছিল কম এবং শর্ত থাকত অনেক সহজ। হোসেনের বক্তব্য অনুযায়ী, বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন পরিমাণ সুদ ছিল। তবে গড়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই হার ছিল ২ থেকে ৩ শতাংশ। তবে এই সুদকে সুদ বলা হতো না, বলা হতো মাসারিফ ইদারীয়া, অর্থাৎ সার্ভিস চার্জ।

ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে সুদ থাকলেও ব্যাংকে টাকা রাখলে কোনো সুদ পাওয়া যেত না। বরং সেক্ষেত্রেও সার্ভিস চার্জ হিসেবে খুবই সামান্য পরিমাণ টাকা কেটে রাখা হতো। অর্থাৎ, গাদ্দাফির সময় ব্যাংকে টাকা রাখলে কোনো সুদ পাওয়া যেত না, কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকা নিলে ঠিকই সুদ দিতে হতো।

গাদ্দাফির পতনের পর থেকে বরং সুদমুক্ত ব্যাংকিং চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেহেতু গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল অধিকাংশই ইসলামপন্থীরা, এবং গাদ্দাফির মৃত্যুর পরেও তারাই ক্ষমতায় এসেছিল, তাই এই পথে তারা কিছুদূর অগ্রসরও হয়েছে। অন্তত একটি ব্যাংক শীঘ্রই সম্পূর্ণ সুদমুক্ত হিসেবে কার্যক্রম চালু করবে বলে শোনা যাচ্ছে।

দাবি ৫: বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের কাছে লিবিয়ার শূন্য ঋণ ছিল

বাস্তবতা: সত্য

এটা গাদ্দাফির অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল। তিনি তার দেশকে পশ্চিমা দেশগুলোর মুখাপেক্ষী হতে দেন নি। লিবিয়াকে প্রায় হতদরিদ্র একটি দেশ থেকে তুলে এনে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। গাদ্দাফির ফরেন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার।

তবে একথাও সত্য, এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ দেশের কাজে গাদ্দাফি খুব কমই ব্যয় করেছেন। আশির দশকের পর লিবিয়ার ইনফ্রাস্ট্রাকচারের তেমন কোনো উন্নয়নই করা হয়নি। যেখানে অন্যান্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর জীবনযাত্রার মান ইউরোপকে ছাড়িয়ে গেছে, সেখানে গাদ্দাফির লিবিয়ার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি – সবকিছুই ছিল মাঝারি মানের। গাদ্দাফি এবং তার ছেলেরা নিজেদের ভোগ-বিলাসের পেছনেও বিপুল অর্থ ব্যয় করতেন।

দাবি ৬: লিবিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিক্ষুক-হীন একটি রাষ্ট্র

বাস্তবতা: সম্পূর্ণ মিথ্যা

আমাদের বিন হাম্মাল মসজিদেই নিয়মিত জুমার নামাজে দুই-তিনজন করে ভিক্ষুক দেখতে পেতাম। তাছাড়া রোজার মাসে এবং ঈদের নামাজেও ভিক্ষুক দেখা যেত। আমাদের ফিতরার টাকা তো সারা জীবন ভিক্ষুকদেরকেই দিয়ে এসেছি।

তবে স্বীকার করতেই হবে, ভিক্ষুকের সংখ্যা ছিল খুবই কম। সাধারণত মসজিদ ছাড়া রাস্তাঘাটে ভিক্ষুক দেখা যেত না। গাদ্দাফির পতনের পর এখন ভিক্ষুকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে এখন প্রায়ই ভিক্ষুক দেখা যায়।

দাবি ৭: গাদ্দাফি বাড়িকে মানুষের মৌলিক অধিকার বিবেচনা করতেন, লিবিয়ার সবার জন্য একটি করে বাড়ি ছিল

বাস্তবতা: আংশিক সত্য

এটা সত্য যে, গাদ্দাফির লেখা কিতাব আল-আখদার তথা দ্যা গ্রিন বুকে বাড়িকে মৌলিক অধিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। এবং প্রথম দিকে, অর্থাৎ সত্তর-আশির দশক পর্যন্ত গাদ্দাফি সবার জন্য বাড়ি তৈরির প্রজেক্টগুলো চালু রেখেছিলেন। সরকারিভাবে প্রচুর অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছিল, যেগুলো বিভিন্ন চাকরিজীবী অথবা এলাকাবাসীর মধ্যে বিতরণ করা হতো।

তবে সবার বাড়ি ছিল, এই দাবিটি অতিরঞ্জিত। ত্রিপোলি, সিরত, মিসরাতা – তিন শহরেই বেশ কিছু লিবিয়ানকে আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকতে দেখেছি। এছাড়া নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে গাদ্দাফি আফ্রিকার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী হওয়ায় এ ধরনের হাউজিং প্রজেক্ট কমিয়ে দিয়েছিলেন।

তাছাড়া অধিকাংশ লিবিয়ানের নিজস্ব বাড়ি থাকলেও সেসব বাড়ির অধিকাংশই ছিল সত্তর-আশির দশকে নির্মিত বাড়ি। আমাদের প্রতিবেশী লিবিয়ানদের বেশিরভাগেরই বাড়ির ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ত। সেটা মেরামত করার মতো আর্থিক সামর্থ্যও তাদের ছিল না।

এছাড়াও এই পয়েন্টে আরেকটি দাবি করা হয়, গাদ্দাফি নিজে পরিবার নিয়ে তাঁবুতে থাকতেন। এটি সত্য নয়। গাদ্দাফি ছয় বর্গমাইল কম্পাউন্ডে অবস্থিত বিলাসবহুল বাড়িতে থাকতেন। তার ছেলেরা একেকজন ইউরোপে বিভিন্ন নাইট ক্লাবে প্লেবয় স্টাইলে জীবন যাপন করতো, যেগুলোর শতশত ছবি এবং ভিডিও ইন্টারনেটে আছে।

তবে গাদ্দাফি অবসর যাপনের সময় অথবা বিদেশী নেতাদের সাথে মিটিং করার সময় তাঁবুতে অবস্থান করতেন, যেগুলো তাঁবু হলেও এয়ারকন্ডিশনিং-সহ বিভিন্ন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ছিল।

দাবি ৮: লিবিয়ার প্রত্যেক নবদম্পতিকে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার ডলার দেওয়া হতো

বাস্তবতা: সম্পূর্ণ মিথ্যা

এই দাবিটা মানুষ কিভাবে বিশ্বাস করে, সেটা একটা আশ্চর্যের ব্যাপার। সে সময় ৫০,০০০ ডলার একটি বিশাল ব্যাপার ছিল। এত টাকা পেলে লিবিয়ানরা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথেই বিয়ে করে ফেলার কথা ছিল।

অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, বিয়ের খরচের তুলনায় মানুষের আয় এত কম ছিল যে, মানুষ সহজে বিয়ে করতে পারত না। পড়াশোনা না করলেও ২৫ বছরের আগে খুব কম মেয়েরই বিয়ে হতো।

বিবাহিতদের ভাতা দেওয়ার একটা নিয়ম অবশ্য চালু করা হয়েছিল ২০০৮ সালে। সেই নিয়ম অনুযায়ী বিবাহিত কিন্তু বেকার ব্যক্তিরা প্রতি মাসে সরকারের কাছ থেকে ৫০০ দিনার ভাতা পেত।

কিন্তু এটা খুবই অযৌক্তিক একটা নিয়ম ছিল। কারণ সে সময় একজন সিনিয়র স্কুল শিক্ষকের বেতনই ছিল সর্বোচ্চ ৩০০ দিনার। একজন জুনিয়র সরকারী ইঞ্জিনিয়ারের বেতন ছিল ৪০০-৫০০ দিনার। অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় এই নিয়মটি বেশিদিন কার্যকর ছিল না।

দাবি ৯: সরকার কৃষি খামারের জন্য ভূমি, বীজসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করত

বাস্তবতা: সত্য

গাদ্দাফি এক সময় সবুজ বিপ্লবের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। এই প্রকল্পের আওতায় পুরো লিবিয়া জুড়ে বিশাল পানির পাইপের নেটওয়ার্ক তৈরি করে সুপেয় পানিকে প্রত্যন্ত মরু অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। সে সময় ফার্মিংয়ের জন্যও গাদ্দাফি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। সরকারিভাবে ফার্মিংয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেওয়া হতো।

দাবি ১০: সন্তান জন্ম দিলে যেকোনো নারীকে ৫০০০ ডলার দেওয়া হতো

বাস্তবতা: আংশিক সত্য

৫০০০ ডলারের ব্যাপারটি পুরাই মিথ্যা। সাধারণ সন্তানের জন্মের ক্ষেত্রে সে দম্পতিকে মাত্র ১৫০ দিনার (১০৭ ডলার) দেওয়া হতো। যদি কারো জমজ সন্তান হতো, তাহলে সে দম্পতি দুই বছর পর্যন্ত প্রতি মাসে ২৫০ দিনার (১৭৮ ডলার) করে ভাতা পেত। আর যদি কারো প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম হতো, তাহলে সে পরিবার আজীবন ৪০০ দিনার (২৮৫ ডলার) করে ভাতা পেত।

দাবি ১১: লিবিয়ার তেল বিক্রির একটা নির্ধারিত অংশ প্রত্যেক নাগরিকের ব্যাংক হিসাব নম্বরে সরাসরি জমা হতো

বাস্তবতা: সম্পূর্ণ মিথ্যা

গাদ্দাফি ২০১০ সালের দিকে একবার এক ভাষণে এরকম একটি পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তার অধিকাংশ বক্তব্যের মতোই এটিরও বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

দাবি ১২: লিবিয়ায় পেট্রোল এবং রুটি খুবই সস্তা ছিল

বাস্তবতা: সত্য

লিবিয়াতে পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি ১৫ গ্যারেশ (১১ সেন্ট), যা সম্ভবত বিশ্বের সর্বনিম্ন। পেট্রোল ছাড়াও লিবিয়া চাল-আটা-তেল-চিনি সহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের উপর বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিত।

লিবিয়ানদের প্রধান খাদ্য খুবজা, যুদ্ধের আগে ১ দিনারে (৭১ সেন্ট) ১০টি খুবজা পাওয়া যেত। যুদ্ধের পর পেট্রোলের দাম আগের মতো থাকলেও চাল-তেল-আটা প্রভৃতির দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

বোনাস দাবি: গাদ্দাফি গোল্ডেন দিনার চালু করতে চেয়েছিলেন

বাস্তবতা: সম্ভবত মিথ্যা

এটিকে আসলে সত্য বা মিথ্যা প্রমাণ করা কঠিন। কারণ এর কোনো প্রমাণ নেই, এটি শুধুই একটি থিওরি। এর প্রধান ভিত্তি হচ্ছে উইকিলিক্সের একটি বার্তা। সেখান থেকে দেখা যায়, বিদ্রোহী এক নেতা আমেরিকান এক কর্মকর্তার কাছে এই দাবি করেছিলেন।

কিন্তু সে সময় আমেরিকাকে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে হামলায় রাজি করানোর জন্য বিদ্রোহী নেতারা প্রচুর মিথ্যা দাবিও করেছিলেন। গাদ্দাফির সেনারা শতশত মানুষকে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলেছে, মেয়েদেরকে গণধর্ষণ করছে, সাধারণ জনগণকে হিউম্যান শিল্ড হিসেবে ব্যবহার করছে – এরকম প্রচুর দাবি তখন তারা করেছিলেন, যেগুলোর পরে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

গাদ্দাফির মৃত্যুর পর গত নয় বছর ধরে এই বিদ্রোহীরাই ক্ষমতায় আছে। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত এমন কোনো ডকুমেন্ট হাজির করতে পারেনি, যা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, গাদ্দাফি আসলেই গোল্ডেন দিনার চালু করতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত গোল্ডেন দিনারের ব্যাপারটি ছিল গাদ্দাফির অন্য শতশত “পরিকল্পনা”র মতোই বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষণ, যা বাস্তবায়ন করার ইচ্ছা তিনি মনের গহীনে লালন করতেন, কিন্তু বাস্তবায়িত করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।

এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে, শেষ এক দশকে গাদ্দাফী পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে পুরোপুরি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডকে সাহায্য করেছিলেন, স্বেচ্ছায় পারমাণবিক কর্মসূচী সম্পূর্ণ বাতিল করেছিলেন, আমেরিকার সাথে কূটনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজিকে পুনর্নিবাচিত করার জন্য গোপনে অর্থ প্রদান করেছিলেন এবং লিবিয়ার অর্থনীতিকেও পশ্চিমামুখী করে ঢেলে সাজাতে শুরু করেছিলেন।

গোল্ডেন দিনার চালুর কোনো পরিকল্পনা যদি গাদ্দাফির আসলেই থেকে থাকে, সেটা সত্তর-আশির দশকের তরুণ বয়সী বিপ্লবী গাদ্দাফির সাথেই বেশি মানায়, শেষ জীবনে পশ্চিমাপন্থী হয়ে ওঠা গাদ্দাফির সাথে মানায় না।

যাইহোক উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, অত্যন্ত জনপ্রিয় এই লিস্টের ১২টি দাবির মধ্যে ৫টিই সম্পূর্ণ মিথ্যা, ৩টি অতিরঞ্জিত, আর ৪টি সম্পূর্ণ সত্য। তবে যে বিষয়টা পরিষ্কার করা দরকার, এই লিস্টের সত্য-মিথ্যা দিয়ে গাদ্দাফির সময়ের চিত্র কিছুই বোঝা যায় না।

আমার এর আগের বিভিন্ন লেখায় যেমন বলেছি, গাদ্দাফির শাসনামলের অনেক ভালো দিক ছিল – আমরা অত্যন্ত নিরাপদে, সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করতাম। আবার অনেক খারাপ দিকও ছিল – সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার সহ অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ দেশের তুলনায় লিবিয়ানরা খুবই গরীব ছিল।

কাজেই গাদ্দাফিকে জোর করে মহামানব পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা করাও বোকামি, আবার তাকে দেশের স্বার্থবিরোধী, স্বৈরাচার হিসেবে হিটলারের সাথে তুলনা করাও অন্যায়। তার দোষগুণ দুটোই স্বীকার করে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকে পর্যালোচনা করাটাই কাম্য। তাহলেই ঘটনাপ্রবাহ সঠিকভাবে বুঝতে সুবিধা হবে।

লেখাটি আপনার ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করতে পারেন, যেন মানুষের ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়।

রেফারেন্স:

দাবিগুলো অনেক সাইটেই আছে। তার মধ্যে কয়েকটি লিংক দিচ্ছি:

১। Global Research ওয়েবসাইটের Libya: Ten Things About Gaddafi They Don’t Want You to Know

২। প্রথম আলো পত্রিকার গাদ্দাফির আমলের নাগরিক সুবিধা অথবা, রাজার হালে ছিলেন গাদ্দাফির প্রজারা

৩। বাংলানিউজ২৪ ডট কম এর কেমন ছিল গাদ্দাফির লিবিয়া

এছাড়া, এই দাবিগুলোকে সম্পূর্ণ মিথ্যা হিসেবে উড়িয়ে দেয়, এরকম এক লিবিয়ানের পোস্টও দেখতে পারেন এখান থেকে। আর লিবিয়া এবং গাদ্দাফী সংক্রান্ত আমার সবগুলো লখা পড়তে পারেন এই লিঙ্ক থেকে

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

8 Comments

  1. আমাদের দেশে এত গবেষণাধর্মী পার্সোনাল ব্লগ লেখক আছে, জানা ছিল না। ধন্যবাদ স্যার, আপনার তথ্যপূর্ণ লেখনীর জন্যে।

    • অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ব্লগগুলো আসলে প্রচার পায় না। এমনিতে বেশ কিছু ভালো ব্লগ আছে।

  2. অনেকদিন আগে অনেক জায়গায় পড়েছি, ধন্যবাদ সত্য তুলে ধরায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *