লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল সফর: নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা

হাফতারের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা বেশ ভালো – এটা গত কয়েক বছর ধরেই শুনে আসছিলাম। স্থানীয় বাংলাদেশীদের মুখেই। এবার দেখার সুযোগ হলো।

বেনগাজির বেনিনা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট যখন নেমেছিলাম, তখন রাত দুইটা বাজে। এই রাতের বেলাই আমরা বেনগাজি থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের আল-মার্‌জের দিকে রওনা দিলাম।

ত্রিপোলিতে দিনের বেলা হলেও দেখা যেত একটু পরপরই অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান ফিট করা টয়োটা পিক-আপ নিয়ে ক্যামোফ্লাজ ট্রাউজার আর স্যান্ডেল পরা, লম্বা চুল-দাড়িওয়ালা মিলিশিয়ারা কাঁধে কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, গাড়ির ভেতরে উঁকি দিয়ে তিনজন পুরুষ দেখামাত্রই রাস্তার পাশে থামাতে বলছে, গাড়ি থেকে নামিয়ে অনর্থক কাগজপত্র নিয়ে ঝামেলা করছে।

অথচ বেনগাজি থেকে মার্‌জ পর্যন্ত এই গভীর রাতেও একটা চেকপয়েন্টেও ঝামেলা করল না। একটু পরপরই চেকপয়েন্ট আছে, কিন্তু সেগুলোতে দাঁড়িয়ে আছে রেগুলার ইউনিফর্ম পরা গোবেচারা চেহারার সাধারণ পুলিশরা। শুধুমাত্র একটা পয়েন্টে গাড়ি থামালো, তাও গাড়ির কাগজ চেক করেই ছেড়ে দিল।

লিবিয়া সংক্রান্ত আমার সবগুলো লেখা পড়তে পারবেন এই লিঙ্ক থেকে।

আল-মার্‌জে এক সপ্তাহ থাকার পর পরের শুক্রবারে বেড়াতে বের হলাম। একটা গাড়ির ভেতর চারজন, সামনে দুইজন লিবিয়ান, পেছনে আমি বাংলাদেশী, আর একজন কোরিয়ান ইঞ্জিনিয়ার। আবারও প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে দারনার ৪০ কিলোমিটার কাছাকাছি পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এলাম, কোথাও থামালো না। গাড়িতে কোরিয়ান থাকা সত্ত্বেও না।

আমার অবাক হওয়া দেখে কোরিয়ান ইঞ্জিনিয়ারটা জানালো, সে প্রতিদিন সকালে কোম্পানির ক্যাম্প থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের সাইটে নিজে টয়োটা হাইলাক্স ড্রাইভ করে যায়, আবার সন্ধ্যার সময় ফিরে আসে। “টয়োটা হাইলাক্স!!!!!” ত্রিপোলি থেকে আসা আমার বস সামনে থেকে অবিশ্বাসের স্বরে জিজ্ঞেস করল। কারণ ত্রিপোলিতে লিবিয়ানরাই টয়োটা হাইলাক্স চালানোর সাহস পায় না। যুদ্ধক্ষেত্রে দারুণ কাজে লাগে বলে মিলিশিয়াদের কাছে এটার চাহিদা প্রচুর।

বেনগাজিতেও যে অপরাধ ঘটে না, এমন না। কিন্তু ত্রিপোলিতে যেরকম নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মিলিশিয়ারাই বড় বড় অপরাধগুলো ঘটায়, এখানে সেরকম না। এখানে মিলিশিয়া নাই, রাস্তাঘাটে রেগুলার পুলিশের উপর মানুষের মোটামুটি ভালোই আস্থা আছে। পুলিশ এখনও অপরাধীদেরকে আতঙ্কে রাখার মতো পারফেক্ট হয়নি, কিন্তু অন্তত পুলিশের দ্বারা হয়রানির ঘটনা অনেক অনেক কমে এসেছে।

আরও পড়ুন: আমার লিবিয়া যুদ্ধের ডায়েরি (১ম পর্ব): ব্যাট্‌ল ফর সিরত

এমন না যে ত্রিপোলির মানুষ খারাপ, বেনগাজির মানুষ ভালো; অথবা হাফতার বিরোধীরা খারাপ, হাফতার সাপোর্টাররা ভালো। আফটার অল সবাই লিবিয়ান। পার্থক্যের কারণটা অন্য জায়গায়। একটা কারণ হচ্ছে, ২০১১ সালের পর থেকে ত্রিপোলিসহ লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে গাদ্দাফির আমলের পুলিশরা কেউ ডিউটি করতে পারছে না। তারা ঘরে বসে বসে বেতন পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রাস্তাঘাট সব “থোওয়ার”দের (বিপ্লবীদের) নিয়ন্ত্রণে। নিয়ন্ত্রণহীন, অস্ত্রধারী এই পাওয়ারফুল মিলিশিয়ারাই যত গণ্ডগোলের মূল।

কিন্তু বেনগাজিসহ পূর্বাঞ্চলে হাফতার যেটা করেছে, গাদ্দাফির আমলের সব আর্মি-পুলিশকে ফিরিয়ে এনেছে। সেই সাথে নিয়মিত নিয়মিত ট্রেনিং দিয়ে নতুন নতুন ব্যাচ তৈরি করছে। কাজেই এখানের আইনশৃঙ্খলা ভালো হবে, এটাই স্বাভাবিক। হাফতারের অধীনেও মিলিশিয়া আছে, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই তারা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত। এবং সেজন্যই যুদ্ধক্ষেত্রে হাফতারের বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচুর মানবাধিকার লঙ্ঘনের রিপোর্ট আছে। যদি কখনও যুদ্ধ শেষ করে এরা শহরে ফিরে আসে, তাহলে সেটা একটা নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।

২০১১ সালে লিবিয়ানরা দুবাইর স্বপ্ন দেখত। এখন অবশ্য সোমালিয়া না হতে পারলেই বাঁচে। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি দেখার পর কিছুটা বুঝতে পারছি, হাফতারের ক্ষমতার লোভ, স্বৈরাচার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, বিদেশী শক্তির আনুগত্য, বম্বিং ক্যাম্পেইন দেখার পরেও লিবিয়ানরা কেন এখনও তার শাসনকে প্রেফার করে।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *