করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট: গ্রামে সংক্রমণ বেশি কেন?

গত বছরের শুরুর দিকে করোনাভাইরাস নিয়ে আমি এবং আমার লিস্টের অনেকে অনেকগুলো সচেতনতামূলক লেখা লিখেছিলাম। রেসপন্স খুব একটা ভালো ছিল না। অনেকের কাছ থেকেই প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক কমেন্টের শিকার হয়েছি।

ইউরোপের অবস্থা দেখে আমাদের আশঙ্কা ছিল যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন না করলে বাংলাদেশেও সেরকম অবস্থা হতে পারে। আমাদের ভাগ্য ভালো সেরকম কিছু হয়নি। কারণটা সম্ভবত করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন জলবায়ুর, বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মানুষের উপর বিভিন্ন রকমের।

কিন্তু যেখানে বিশ্বের অনেক দেশ আক্রান্ত হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে, সেখানে বাকি কিছু দেশে বেশি সংক্রমণ না হলে সেটাকে রুল হিসেবে না ধরে এক্সেপশন হিসেবে ধরাই ভালো। এবং আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে এবার হয়নি, কিন্তু পরের বারও যে হবে না, তার নিশ্চয়তা কী, সেটা চিন্তা করে সাবধান হওয়াই ভালো।

কিন্তু সেটা হয়নি। সরকারের ব্যর্থতা তো ছিল এবং আছেই, সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল বিপুল সংখ্যক মানুষের অন্ধবিশ্বাস – করোনায় আমাদের কিছু হবে না, করোনা একটা কন্সপিরেসি, করোনা শুধু বড়লোকদের রোগ, মুসলমানদের এই রোগে কিছু হবে না, গ্রামের মানুষের বা বস্তির মানুষের করোনা হবে না … ইত্যাদি ইত্যাদি।

শুধু বলুন ঠিক কি না টাইপ ওয়াজকারী বা অশিক্ষিতদের মুখে না, এরকম সুর ছিল শিক্ষিতদের মুখেও। আমি সব সময়ই মোটামুটি মাঝামাঝি অ্যাপ্রোচ রাখার চেষ্টা করি তাই আমি খুব একটা আক্রমণের শিকার হইনি। কিন্তু জিয়া হাসান ভাইসহ যারা এ ব্যাপারে এন্থুসিয়াস্টিকভাবে লেখালেখি করেছিলেন, পরের দিকে তাদের যেকোনো পোস্টের নিচেই এক শ্রেণির মানুষ এসে মন্তব্য করত – আপনাদের মাঠেঘাটে পড়ে থাকা লাশগুলো কোথায়? ব্যাপারটা এমন যেন মানুষকে সতর্ক করাটাই অন্যায়।

অথচ ওয়ার্নিংগুলো ছিল এক্সট্রিম কেসের। যেরকম দুনিয়ার সব ওয়ার্নিংয়ের ক্ষেত্রে হয়। যেমন কয়েক দশক আগে শোনা যেত যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে এত বছর পর দেশের ধারণক্ষমতা ফুরিয়ে যাবে। অথবা যে হারে হিমালয়ের বরফ গলছে তাতে এত সাল নাগাদ দেশ পানির তলে ডুবে যাবে। বাস্তবে এগুলো একটাও হয়নি, কারণ মানুষ একেবারেই কিছু না করে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেনি। ফাইট করে গেছে।

এখানেও ব্যাপারটা সেরকম। প্রথমদিকের ভ্যারিয়েন্টগুলো বাংলাদেশের জন্য ফ্যাটাল ছিল না, এটার পাশাপাশি প্রথম দিকে ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া, কয়েক দফায় লক ডাউন দেওয়া, বিভিন্ন পাবলিক গ্যাদারিংয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ করা, জনসংখ্যার ছোট একটা অংশের মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তোলা – এগুলো সবগুলোর একটা কম্বাইন্ড এফেক্টও হয়তো ছিল। এগুলোর কোনোটাই না করা হলে হয়তো প্রথম ওয়েভেই অবস্থা আরও খারাপ হতে পারত।

নাহ, বাস্তবে মাঠেঘাটে লাশ পড়ে থাকত না। ইনফ্যাক্ট প্রায় কোনো দেশেই পড়ে থাকেনি। কিন্তু স্বাস্থ্যখাত-সহ প্রতিটা বিষয়ে ম্যানেজমেন্টের যে অবস্থা, তাতে বর্তমানের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি সংক্রমণ হলেও কি সেটা যথেষ্ট খারাপ হতো না? সাবধান হওয়ার জন্য লাখ লাখ মৃত্যুর মতো এক্সট্রিম অবস্থায় যাওয়া পর্যন্তই আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে কেন?

সরকারের ব্যর্থতা এবং অব্যবস্থাপনাকে কনস্ট্যান্ট ধরলেও সাবধানতা এবং অসাবধানতা অবলম্বন করার মধ্যে পার্থক্যটা চোখে পড়ে। এক্স্যাক্ট ডাটা পাওয়া তো মুশকিল, কিন্তু মানুষের সাথে কথা বললে কি আপনাদের মনে হয় না, এই মুহূর্তে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এর কারণে শহরের চেয়ে গ্রামের দিকে অবস্থা বেশি খারাপ?

ঢাকায় আমাদের যত আত্মীয়-স্বজন আছে, তাদের বা তাদের আশেপাশের মানুষেরা গত দেড় বছর ধরে মোটামুটি সুস্থ আছে। কিন্তু দেশের বাড়িতে ঘরে ঘরে মানুষ অসুস্থ। আব্বুর এক কাজিন মারা গেল কিছুদিন আগে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমিত হয়ে। তার কয়েক বাড়ি পরে এক বাড়িতেই মারা গেল ছয়জন। অথচ গ্রামে, খেটে খাওয়া মানুষদের নাকি করোনা হওয়ারই কথা ছিল না!

এই যে শহরের চেয়ে গ্রামে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণের হার বেশি, এর পেছনে অসাবধানতাটাকেই বেশি দায়ী বলে মনে হয় না? শহরে তো যখনই লক ডাউন দেয়, সেটা কিছুটা হলেও কার্যকর হয়। যারা চাকরি-বাকরি করে, তাদের ছুটি থাকে। বাকিরাও একে অন্যের দেখাদেখি মাস্ক পরে, স্যানিটাইজার ব্যবহার করে। কিন্তু গ্রামে? সেখানে মানুষ অন্ধবিশ্বাস নিয়ে বসে আছে – আমাদের করোনা হবে না। আর এই অন্ধবিশ্বাসই তাদের কাল হচ্ছে এখন।

ইউরোপ প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে গেছে। সৌদি আরও আজ উমরাহ’র উপর থেকে লিমিটেশন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এবং এগুলো তারা করতে পেরেছে যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে এরপর সময়মতো ভ্যাক্সিন দিতে পারার ফলেই।

আর আমরা? আমাদের সরকার যেরকম, জনগণও সেরকম। সরকারই নীতি ঠিক করতে পারছে না, তার উপর আমরা এখনও সমানে অ্যান্টি-ভ্যাক্সিন কন্সপিরেসি আর আমরা সুপারম্যান, আমাদের কিছু হবে না থিওরি নিয়ে বসে আছি।

আমাদের এই ব্যর্থতা, অসাবধানতা এবং অন্ধবিশ্বাসের কারণে আমাদেরকে ভুগতে হবে আরও অনেকদিন। সেটা শুধু সরাসরি মৃত্যুর মাধ্যমে না। প্রাসঙ্গিক অন্যান্য ঘটনার মধ্য দিয়েও। অলরেডি আরব আমিরাত ভারত-পাকিস্তান-সহ ছয় দেশ থেকে ছুটিতে যাওয়া রেসিডেন্সি পারমিটধারীদের ফেরার অনুমতি দিয়েছে। দেয়নি কেবল বাংলাদেশীদেরকে।

এই দুঃসময়ে সুস্থ থাকাটাই একটা বড় নিয়ামত। সেটা নিয়ে আমাদের শোকর করার কথা ছিল। এবং যেন এই সুস্থতা ধরে রাখা যায়, তার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা না করে আমরা করছি অহংকার – উই আর সুপারবাঙালি!

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *