CIA যেভাবে বাদশাহ হোসেন এর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ভেস্তে দিয়েছিল

১৯৫৮ সালের ঘটনা। ওয়াশিংটনের মিসরীয় দূতাবাসে আড়ি পাততে গিয়ে সিআইএ জানতে পারে, মিসরের উদ্যোগে উচ্চপদস্থ কিছু জর্ডানীয় সেনা অফিসার জর্ডানের বাদশাহ হুসেইনকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছে।

মিসরের ক্ষমতায় তখন প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের। তার আমেরিকা এবং ইসরায়েল-বিরোধী বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী অবস্থান সমগ্র আরব বিশ্বে ঢেউ তুলেছে। অন্যদিকে জর্ডানের ক্ষমতায় হাশেমী রাজবংশের ২২ বছর বয়সী তরুণ বাদশাহ – হুসেইন বিন আব্দুল্লাহ।

বলা হয়ে থাকে, হাশেমীরা রাসুল (সা) এর বংশধর। কিন্তু বাস্তবে কয়েক পুরুষ ধরেই তারা ছিল ব্রিটিশ এবং আমেরিকানদের ঘনিষ্ঠ মিত্র। কাজেই সিআইএ সিদ্ধান্ত নেয় – যেকোনো মূল্যে নাসেরপন্থী সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে বাদশাহ হুসেইনের ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে।

আম্মান স্টেশন চীফের দায়িত্ব নিয়ে তারা জর্ডানে প্রেরণ করে নতুন একজন সিআইএ অফিসারকে। তার নাম – জ্যাক ও কনেল। তার মিশন – অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সবাইকে খুঁজে বের করা এবং তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করে বাদশাহ হুসেইনকে রক্ষা করা।

ভিডিও দেখুন ইউটিউব চ্যানেলে

জর্ডানে পৌঁছেই কাজে লেগে পড়েন জ্যাক ও কনেল। যে জর্ডানিয়ান জেনারেল মিসরীয়দের সাথে যোগাযোগ রাখছিল, জর্ডানিয়ান ইন্টেলিজেন্সের সাথে মিলে তিনি তার ফোন ট্যাপ করানোর ব্যবস্থা করেন।

কয়েকদিনের মধ্যেই তারা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার সাথে যুক্ত ২২ জন সন্দেহভাজনকে সনাক্ত করতে সক্ষম হন এবং বাদশাহর কাছে তাদের নামের তালিকা পাঠিয়ে দেন। এই ২২ জনের প্রত্যেকে ছিল বাদশাহর পূর্ব পরিচিত। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাদশাহ তাদের সবার উপর নজরদারি শুরু করার অনুমতি দেন।

জুন মাসের শেষের দিকে সিআইএর হেডকোয়ার্টার থেকে ও কনেলকে জানানো হয়, তারা সিরিয়া থেকে জর্ডানিয়ান সেনা অফিসারদের কাছে পাঠানো একটি রেডিও বার্তা ইন্টারসেপ্ট করেছে, যেখানে তাদেরকে অবিলম্বে অভ্যুত্থান শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সে সময় সিরিয়া এবং মিসর ছিল একীভূত ইউনাইটেড আরব রিপাবলিকের সদস্য। এবং সিরিয়ার সেনাবাহিনী ছিল মিসরীয় সেনাবাহিনীর অধীনস্থ। ও কনেল বুঝতে পারেন, সিরিয়া এবং মিসর উভয়ে মিলেই এই অভ্যুত্থানে সহযোগিতা করছে।

সেদিন রাতেই তিনি বাদশাহ হুসেইনকে এই তথ্য জানান। তার পরামর্শ অনুযায়ী সেদিন রাতেই বাদশাহ ঐ ২২ সেনা অফিসারকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন।

সমস্যা শুরু হয় পরদিন সকাল থেকে। গ্রেপ্তারকৃত অফিসাররা প্রত্যেকে ছিল প্রভাবশালী বিভিন্ন গোত্রের সদস্য। সেসব গোত্রের অনেক সদস্য ছিল বাদশাহর কাছের মানুষজন। তারা বাদশাহর উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে – তাদের ছেলেদের অপরাধের প্রমাণ হাজির করতে হবে, আর না হলে তাদেরকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।

সমস্যা হয়, এই ২২ জনের মধ্যে শুধু একজন – যে মিসরীয় সেনা অফিসারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখছিল – তার বিরুদ্ধেই পরিষ্কার প্রমাণ ছিল। বাকি সবার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ তখনও জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ ছিল সারকামস্ট্যানশিয়াল বা পরোক্ষ, যা আদালতে টিকবে না।

ওদিকে বন্দীরা কেউ মুখ খুলছিল না। তারা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে যাচ্ছিল। উপায় না দেখে বাদশাহর সামরিক উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ রাসুল এক অভিনব বুদ্ধি বের করেন।

তিনি ও কনেলকে প্রস্তাব দেন, জর্ডানে যেহেতু প্রফেশনাল কোনো ইন্টারোগেটর নেই, তাই তাদের উচিত সিআইএ থেকে একজন ইন্টারোগেটর নিয়ে আসা। কিন্তু সেই ইন্টারোগেটরকে হতে হবে নন-আমেরিকান। এবং তাকে ভান করতে হবে, সে ইন্টারোগেটর না, বরং সে একজন আইনজীবি, যাকে বাদশাহ নিয়োগ দিয়েছেন বন্দীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য।

ও কনেল ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে পারছিলেন না। যাদের বিরুদ্ধে বাদশাহকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ, তাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সেই বাদশাহ নিজেই কেন বিদেশ থেকে আইনজীবি এনে নিয়োগ দিবেন? আর সেই বন্দীরাই বা কেন সেই কাহিনী বিশ্বাস করবে?

লেফটেন্যান্ট রাসুল উত্তর দিলেন, আপনি আমাদের বাদশাহকে চেনেন না। তার ঠিক এই কাজটাই করার কথা। এবং বন্দীরাও তাকে চেনে বলেই এই কাহিনী বিশ্বাস করবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী পিটার নামে সিআইএর এক পোলিশ আইনজীবিকে জর্ডানে আনা হয়। বন্দীরা সবাই ঠিকই একবাক্যে তাকে বিশ্বাস করে। কিন্তু তারপরেও তারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করতে রাজি হয় না।

ও কনেল যখন হতাশ, ঠিক এমন সময় একদিন হেডকোয়ার্টার থেকে দারুণ একটা সংবাদ আসে। জানা যায়, বন্দীদের মধ্যে একজন অফিসার ট্রেনিংয়ের জন্য কিছুদিন আমেরিকায় ছিল। সেখানে থাকাকালে সে এক মার্কিন নারীর সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিল। সিআইএ জানায়, ঐ নারী এখন এক অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়েছে, যেই সন্তানের বাবা ঐ অফিসার।

ও কনেল বুঝতে পারেন, এই তথ্য দিয়েই ঐ অফিসারকে ব্ল্যাকমেইল করা সম্ভব। তিনি পিটারকে তথ্য দিলে পিটার ঐ অফিসারের কাছে যান এবং বলেন, তার প্রেমিকা অ্যালিসের ঘরে তার একটি সন্তানের জন্ম হয়েছে এবং সেই সন্তান অ্যালিস নিয়ে জর্ডানে আসার পরিকল্পনা করছে।

এই তথ্য শুনে যখন ঐ অফিসারের হাঁটু ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়, তখন পিটার বলেন, বাদশাহকে এই সংবাদ জানানো হয়েছে। এবং বাদশাহ যেহেতু ভালো মানুষ, তাই তিনি চান না এসব ঘটনা নিয়ে কোনো স্ক্যান্ডাল হোক, এরকম সম্ভ্রান্ত বংশের কারো মর্যাদার হানি ঘটুক। কাজেই বাদশাহ ঐ প্রেমিকাকে টাকা দিয়ে তার জর্ডানে আসার সম্ভাবনা বন্ধ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ বাদশাহ বলতে গেলে ঐ অফিসারের জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

এখন প্রতিদান হিসেবে ঐ অফিসারের একটাই করণীয় আছে – অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কথা স্বীকার করা। আর তাছাড়া বাদশাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কেউ অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে।

ঐ অফিসারের আর কোনো উপায় ছিল না। বিনা বাক্য ব্যয়ে সে লিখিত আকারে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেয়। তার সেই লিখিত বক্তব্যকে ব্যবহার করে পিটার আরও চারজনের কাছে স্বীকারোক্তি আদায় করেন।

তখনও আরও ১৭ জনের স্বীকারোক্তি আদায় করা বাকি ছিল। কিন্তু ওদিকে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। একসাথে সবার মুখ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য পিটার এক অভিনব বুদ্ধি বের করেন।

তিনি ২২ বন্দীকে একসাথে বিশাল একটি কনফারেন্স রুমে হাজির করেন। রুমটির চারপাশের দেয়ালে ২২টি ডেস্কের উপর খাতা এবং কলম রাখা ছিল।
পিটার তাদেরকে শেষবারের মতো ওয়ার্নিং দেন – বাদশাহ হুসেইন তার ধৈর্য্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছেন। এটাই তাদের অপরাধ স্বীকার করার শেষ সুযোগ। যারা অপরাধ স্বীকার করবে, বাদশাহ তাদেরকে লঘু শাস্তি দিবেন। কিন্তু অপরাধ করেও যদি কেউ স্বীকার না করে, তার শাস্তি হবে ভয়াবহ।

উপস্থিত ২২ জনের মধ্যে ১৭ জন তখনও জানত না যে, ৫ জন আগেই অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পিটারের ওয়ার্নিং শেষ হওয়ার পর ঐ ৫ অফিসার এক পা এগিয়ে এসে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নেয় এবং ডেস্কে গিয়ে লিখিত জবানবন্দী দিতে শুরু করে।

তাদের এই পদক্ষেপ দেখে বাকি ১৭ অফিসার ঘাবড়ে যায়। অপরাধ স্বীকার করা ছাড়া তাদেরও আর কোনো উপায় থাকে না।

পরদিন জ্যাক ও কনেল ২২ জনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী একসাথে নিয়ে বাদশাহ হুসেইনের হাতে তুলে দেন। ২২ অফিসার গ্রেপ্তার হওয়ার পরেই বাদশাহ অভ্যুত্থানের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গিয়েছিলেন, এখন তাদের স্বীকারোক্তি পাওয়ার পর রাজনৈতিক সংকট থেকেও তিনি বেঁচে গেলেন।

আর ঐ ২২ অফিসারের ভাগ্যে কী হয়েছিল? লেফটেন্যান্ট রাসুল যেরকম দাবি করেছিলেন, জ্যাক ও কনেল আসলেই বাদশাহকে চিনতে পারেননি। বাদশাহ সবাইকেই বিচারে তোলেন, কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে ৫ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। বাকি ১৭ জনের ৫ থেকে ১০ বছরের লঘু কারাদণ্ড হয়। কিন্তু তাদের অনেককেও শাস্তির মেয়াদ পূরণ হওয়ার আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়।

মুক্তি পাওয়ার পর সবাই আবার সমাজে পুনর্বাসিত হয়। অনেকে জর্ডানের সিকিউরিটি এবং ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে চাকরিও পায়। প্রধান যে অভিযুক্ত, জেনারেল রুসান, যার সাথে মিসরীয় সেনা অফিসারদের যোগাযোগ ছিল, তিনিও মুক্তি পাওয়ার পর রাজনীতি শুরু করেন, সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং বেশ কয়েক বছর সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আসলেই বড় অদ্ভুত। এখানে গোত্র, পরিবার, সমাজ এবং রাজপরিবার সবকিছু এমনভাবে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত থাকে যে, অনেক সময় চরম শত্রুকেও ক্ষমা করে দিতে হয়, কাছে টেনে নিতে হয়।

সিআইএ অফিসার জ্যাক ও কনেল সম্পর্কিত আরেকটি ইন্টারেস্টিং ঘটনা পড়ুন এখান থেকে। অথবা ভিডিও দেখুন এখান থেকে

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *