পার্মানেন্ট রেকর্ড: এডওয়ার্ড স্নোডেনের আত্মজীবনী

এডওয়ার্ড স্নোডেনকে কি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু আছে? মনে হয় না। এডওয়ার্ড স্নোডেন-অ্যাসাঞ্জরা হচ্ছে এই সময়ের বিপ্লবী গেরিলা, অস্ত্রের পরিবর্তে প্রযুক্তিই যাদের শেষ ভরসা।

পার্মানেন্ট রেকর্ড (Permanent Record) বইটা এডওয়ার্ড স্নোডেনের আত্মজীবনী। মিডিয়াতে আমরা স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যগুলো সম্পর্কেই বেশি আলোচনা শুনি, সেই তুলনায় ব্যক্তি স্নোডেন সম্পর্কে খুব বেশি আলোচনা শুনি না। যেটুকু শুনি, “লো লেভেল টেক কন্ট্রাক্টর টার্নড হ্যাকার”, সেটুকুও মার্কিন সরকারি ভাষ্য দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। এই বইটা স্নোডেন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সেই ঘাটতিটুকুই পূরণ করবে।

বইটাতে স্নোডেনের ফাঁস করা মার্কিন গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর গোপন তথ্য সম্পর্কে, কিংবা মার্কিন প্রশাসনের গোপন কার্যক্রম সম্পর্কে নতুন এমন কোনো চাঞ্চল্যকর তথ্য নেই, যা আমরা জানি না। বইটার ফোকাস মূলত স্নোডেনের নিজের জীবন। ছোটকাল থেকে ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি পরিবারে তার বেড়ে ওঠা, অসাধারণ মেধাবী হিসেবে অল্প বয়সেই দক্ষ হ্যাকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা, কিশোর বয়সেই নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটির সার্ভার হ্যাক করে তাদের কাছ থেকে চাকরির অফার পাওয়া – প্রতিটা অধ্যায়েই স্থান পেয়েছে তার জীবনের এরকম ইন্টারেস্টিং ঘটনাগুলো, যেগুলো এতদিন আমাদের কাছে অজানা ছিল।

তবে ফাঁস হওয়া তথ্য সম্পর্কে নতুন কিছু না থাকলেও যে কারণে বইটা সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত এবং আলোচিত হচ্ছে, সেটা হচ্ছে তথ্য ফাঁস করার পেছনের কাহিনী স্নোডেন এই বইয়ে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত গোছানো পদ্ধতিতে। সিআইএ এবং এনএসএর লোভনীয় ক্যারিয়ার ছেড়ে এত অল্প বয়সেই এত বিপুল পরিমাণ তথ্য ফাঁস করে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলার মতো দুঃসাহসী কাজের পেছনে তার যুক্তিগুলো, তার চিন্তাভাবনাগুলো, এবং পদে পদে তার চ্যালেঞ্জগুলো এতে উঠে এসেছে বিস্তারিতভাবে। ঠিক কেন তিনি সরাসরি জনগণের কাছে এসব তথ্য উন্মুক্ত না করে সংবাদপত্রের মাধ্যমে উন্মুক্ত করেছেন, তার পেছনেও স্নোডেন চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

বইয়ে টেকনোলজি সংক্রান্ত প্রচুর কথাবার্তাও আছে। কিন্তু এডওয়ার্ড স্নোডেন প্রতিটা বিষয় এতো বিস্তারিতভাবে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদাহরণ এবং উপমার সাহায্যে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, নন টেকি সাধারণ পাঠকদেরও বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না। সরকারি সার্ভেইল্যান্স এড়ানোর জন্য তাকে যে বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, সেটা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়।

বইয়ের একটা জায়গায় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কথাও উঠে এসেছে। অ্যাসাঞ্জ সম্পর্কে স্নোডেনের অবস্থান বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। স্নোডেন অ্যাসাঞ্জের কাজের গুরুত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, তাকে বাঁচানোর জন্য অ্যাসাঞ্জের প্রতি কৃতজ্ঞতা (স্নোডেনকে হংকংয়ের আটকাবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য অ্যাসাঞ্জই একজন আইনজীবী পাঠিয়েছিলেন) প্রকাশ করেছেন। কিন্তু একইসাথে অ্যাসাঞ্জের প্রতি তার ঋণাত্মক মনোভাবও বেশ পরিষ্কারভাবেই উল্লেখ করেছেন।

স্নোডেনের ভাষায়, অ্যাসাঞ্জ হচ্ছেন “সেলফ ইন্টারেস্টেড, ভেইন, মুডি এবং বুলিইং”, যিনি নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য “যেকোনো কিছু” করতে রাজি। স্পষ্টতই স্নোডেনের কর্মপদ্ধতি এবং দর্শন এবং অ্যাসাঞ্জের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের এই ভিন্নতা তাদের পরিচয়ের এক মাসের মধ্যেই এতো বেশি প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, এরপর থেকে তাদের মধ্যে আর কখনো যোগাযোগ হয়নি।

এডওয়ার্ড স্নোডেন সম্পর্কে ইন্টারনেটে অনেক মিথ প্রচলিত আছে। ফেক নিউজ ছড়ানো ওয়েবসাইটগুলোর কল্যাণে এবং বাংলাদেশী পত্রিকাগুলোর সেসব নিউজের সত্যাসত্য যাচাইয়ে ব্যর্থতার কারণে অনেকেরই বিশ্বাস, স্নোডেন নাকি বলেছেন ওসামা বিন লাদেন আসলে এখনও মারা যায়নি, সিআইএর তত্ত্বাবধানে বাহামাতে বসে মাসে লাখ ডলার বেতন নিচ্ছে! এছাড়াও আরব বসন্তসহ দুনিয়ার অনেক কিছুর জন্যই আমেরিকার ষড়যন্ত্রকে নিয়মিত দায়ী করা হয় স্নোডেনের বরাত দিয়ে।

এই দাবিগুলোর অসাড়তা এমনিতেই বোঝা যায়। এবং স্বাভাবিকভাবেই এই বইয়েও এই দাবিগুলোর স্বপক্ষে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বরং স্নোডেনকে আরব বসন্তের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবেই দেখা গেছে। আরব বসন্তের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে স্নোডেন মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের পতনের এবং জনগণের মুক্তির প্রয়োজনীয়তা বেশ জোরালোভাবে উল্লেখ করেছেন। এমনকি এই অঞ্চলের, বিশেষ করে ইরানের আন্দোলনকারীরা যেন সরকারের নজরদারি এড়িয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে, সেজন্য স্নোডেন নিজেই একটা টর-বেজড সার্ভার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

প্রতি বছরই বেশ কিছু আত্মজীবনীমূলক বই আলোচিত এবং প্রশংসিত হয়। এ বছর যে কয়টা বই টুইটারে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হতে দেখেছি, এটা তার মধ্যে অন্যতম। গুডরিডসে এই বইয়ের রেটিং ৪.৪২/৫

আপনার যদি এই লেখাটা ভালো লেগে থাকে, তাহলে এই লেখাটাও পড়ে দেখতে পারেন:

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

2 Comments

    • প্রজন্ম প্রকাশনী সম্ভবত বাংলা অনুবাদ করছে। এছাড়া আমার নিজেরও প্ল্যান আছে ইন্টারেস্টিং অংশগুলো সিরিজ আকারে রোর বাংলার জন্য অনুবাদ করব। আগামী মাসের মাঝামাঝি হয়তো শুরু করব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *