কোন ধরনের বই কোন ফরম্যাটে পড়বেন?

বই মানেই বাঁধাই করা চামড়ার মলাটের ভেতর মুদ্রিত কাগজের সমষ্টি – এই ধারণাটা পুরনো হয়ে গেছে। বই এখন পড়া যেতে পারে পিডিএফ, ইপাব, মোবি বা অন্য যেকোনো ফরম্যাটে। অথবা বই শোনা যেতে পারে অডিও বুক থেকেও।

বই পড়া, জ্ঞান অর্জন করা কিংবা সাহিত্যের রস আস্বাদন করাই যদি আপনার মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে আপনি হয়তো ফরম্যাটকে খুব একটা গুরুত্ব দিবেন না। স্থান-কাল ভেদে কিংবা সহজলভ্যতার উপর ভিত্তি করে আপনার জন্য হয়তো ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বা ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ফরম্যাটে বই পড়াই সবদিক থেকে উপকারী হতে পারে।

কথা হচ্ছে সব বই কি সব ফরম্যাটে পড়ার উপযোগী? বলা মুশকিল। এটা যার যার রুচি বা অভ্যাসের উপর নির্ভর করতে পারে। আমি বরং নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি – কোন ধরনের বই আমি কোন ফরম্যাটে পড়তে পছন্দ করি। আপনার পছন্দের সাথে নাও মিলতে পারে, তবে হয়তো একটা ধারণা পেতেও পারেন।

১। হার্ড কপি বা কাগজের বই

যেহেতু এটাই ক্লাসিক্যাল ফরম্যাট, তাই বাছ-বিচার ঠাড়া সব ধরনের বই এই ফরম্যাটে পড়া যায়। তবে যেহেতু আমি প্রবাসে থাকি, এবং এমন এক দেশে থাকি যেখানে মানুষ বই পড়ে না, তাই আমার কাছে কাগজের বই জিনিসটা বেশ দুর্লভ।

তারপরেও বাংলা কোনো বই যদি হাতে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে আমি সেটা হার্ড কপিতেই পড়তে পছন্দ করি। ইংরেজি বইয়ের ক্ষেত্রে অবশ্য হাতে পেলেও আমার পছন্দ অন্যান্য ফরম্যাট। কেন সেটা নিচের দুইটা পয়েন্টে বলছি।

২। সফট কপি

সফট কপির ক্ষেত্রে আমার প্রথম পছন্দ ইপাব (*.epub)। তবে সেটা শুধু ইংরেজি বইয়ের ক্ষেত্রে। বাংলা ইপাবের সংখ্যা যেহেতু একেবারেই কম, তাই সেক্ষেত্রে পিডিএফের বিকল্প নাই। কিন্তু বাংলা ইপাব থাকলেও যদি ল্যাপটপে পড়তে হয়, তাহলে আমার কাছে পিডিএফই ভালো লাগে।

ইংরেজি বইয়ের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইংরেজি নন-ফিকশন বইয়ের ক্ষেত্রে (ইতিহাস, রাজনীতি) আমার একমাত্র পছন্দ ইপাব ফরম্যাট। এবং এর জন্য আমি অ্যান্ড্রয়েড ফোনে মুন প্লাস রিডার (Moon+ Reader) অ্যাপটা ব্যবহার করি।

কেন ইপাব পছন্দ? কারণ ইতিহাস এবং রাজনীতি বিষয়ক পড়ার সময় আমার অভ্যাস হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো হাইলাইট করে রাখা এবং পুরো বই পড়া শেষ হলে হাইলাইট করা অংশগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে যাওয়া। এতে তথ্যগুলো মনে রাখতে সুবিধা হয়। এছাড়াও যেহেতু টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস আছে, তাই গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো হাইলাইট করা থাকলে পরে কাজে লাগে।

মুন প্লাস রিডারে ইপাব ফাইলগুলোতে টেক্সট হাইলাইট করা খুবই সহজ। এবং হাইলাইট করা অংশগুলো অটোম্যাটিক ড্রপবক্সে বা গুগল ড্রাইভে সিঙ্ক হয়ে যেতে থাকে। ফলে যেকোনো সময় দরকার হলে সেখান থেকে হাইলাইট করা অংশগুলো টেক্সট ফাইল হিসেবে ইমপোর্ট করে যেকোনো কাজে ব্যবহার করা যায়।

৩। অডিও বুক

অডিও বুক হচ্ছে পুরো বইয়ের অডিও ভার্সন। সাম্প্রতিক সময়ের প্রায় সবগুলো আলোচিত বইয়েরই অডিও বুক পাওয়া যায়। অফিশিয়ালিই সেগুলো তৈরি করা হয়। এবং সেগুলোর ভয়েস স্ট্যান্ডার্ড, সাউন্ড কোয়ালিটি প্রফেশনাল লেভেলেরই হয়।

যারা কখনো শোনেননি, তাদের হয়তো সন্দেহ হতে পারে, বই তো পড়ার জিনিস, অডিও শুনতে কি মজা লাগবে?

এখানে দুইটা বিষয় আছে। একটা হচ্ছে সময়কে কাজে লাগানো। যেমন আমি এর আগে যখন ত্রিপোলিতে ছিলাম, তখন একটা সময় বাসা থেকে অফিসে যেতে সময় লাগত আধঘণ্টা। এই আধঘণ্টা সময় ড্রাইভ করা ছাড়া দুনিয়ার আর কিছু করার উপায় ছিল না – কেবলমাত্র অডিও শোনা ছাড়া। এছাড়াও সন্ধ্যার আগে বা রাতে আমার মাঝে মাঝে আধঘণ্টা বা একঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস আছে। এই সময়টাও পুরোটাই অপচয় হতো যদি অডিও বুক জিনিসটা দুনিয়াতে না থাকত।

দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে, কিছু কিছু বইয়ের অডিও আসলেই চমৎকার হতে পারে। কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ এবং বাচনভঙ্গি এতো সুন্দর হতে পারে, মনে হতে পারে কেউ যেন সামনে বসে কাহিনীটা বর্ণনা করছে। যেমন আমি স্পেসিফিক্যালি দুইটা অডিও বুকের কথা উল্লেখ করছি। যদি আগে কখনো শোনার অভ্যাস না থাকে, তাহলে এই দুইটা ট্রাই করে দেখতে পারেন।

প্রথমটা হচ্ছে মেক্সিকান অভিনেত্রী Yereli Arizmendi এর কণ্ঠে পাউলো কোয়েলিওর The Alchemist এর ন্যারেশন। এতো সুন্দর কণ্ঠ, এতো চমৎকার বর্ণনা, সেই সাথে কিছু কিছু জায়গায় এমন দারুণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, আপনার কাছে মনে হবে আপনি বুঝি মরুর বুকে সান্তিয়াগো আর ফাতিমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

দ্বিতীয়টা হচ্ছে Atossa Leoni এর কণ্ঠে আফগান-আমেরিকান ঔপন্যাসিক খালেদ হোসেইনির উপন্যাস A Thousand Splendid Suns এর ন্যারেশন। এটাও অসাধারণ।

এই কণ্ঠশিল্পী ইরানি বংশোদ্ভূত হওয়ায় তিনি উপন্যাসের ভেতরে ব্যবহৃত বিভিন্ন আফগান/পশতু শব্দ এবং বাক্যাংশ, মানুষ এবং শহরগুলোর নাম এমনভাবে বিশেষ আঞ্চলিক টানে উচ্চারণ করতে পেরেছেন, যা সাধারণ পাঠকদের পক্ষে চিন্তা করা সম্ভব ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের ডায়লগ উচ্চারণ করার সময় তিনি যেরকম ভিন্ন ভিন্ন টোন ব্যবহার করেছেন, তাতে পড়ার সময় দৃশ্যগুলো কল্পনা করতে অনেক বেশি সহজ হয়।

তবে সব ধরনের বই অডিও বুক হিসেবে শুনতে ভালো লাগবে না। আমার মতে প্রাথমিক অবস্থায় অডিও বুক শোনার সময় যেকোনো জটিল বই এড়িয়ে চলা উচিত। এটা নন-ফিকশনের জন্য তো সত্য বটেই, উপন্যাসের জন্যও সত্য।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের 100 Years of Solitute উপন্যাসটা আমি প্রথমে অডিও বুক হিসেবে শুনতে শুরু করেছিলাম। প্রথম দিকে ভালোই লাগছিল, কিন্তু যখন একের পর এক আর্কাদিও আর অরেলিয়ানোরা এসে চরিত্রগুলোর মধ্যে প্যাঁচ বাঁধাতে শুরু করল, তখন খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। এরপর বাধ্য হয়ে বাকিটা ইপাব ভার্সনে গিয়ে শেষ করতে হয়েছিল।

আমার মতে তাই অডিও বুকের জন্য সিম্পল কাহিনীর উপন্যাস এবং মোটিভেশনাল বা সাধারণ জ্ঞানমূলক বই বেস্ট। জটিল কাহিনীর উপন্যাস, বা নোট নিতে হয় এমন নন-ফিকশনের জন্য ইপাব ভালো। আর হার্ডকপি ভালো সব ধরনের বইয়ের জন্যই – যদি সময় থাকে, এবং সহজলভ্য হয়।

বইপত্র সম্পর্কিত আমার সবগুলো লেখা পড়তে ক্লিক করুন এখানে। একইসাথে এখানে পাবেন বিভিন্ন বইয়ের উপর আমার লেখা রিভিউও।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *