করোনাভাইরাস নিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা!!!

ভয়াবহ একটা অভিজ্ঞতা হলো আজ।

রাত আড়াইটা বাজে। একা একা রাত জেগে Roar বাংলার জন্য একটা আর্টিকেল দাঁড় করাচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ দূরে কোথা থেকে যেন একটা করুণ কান্নার সুর ভেসে এলো।

আমার সারা শরীর ছমছম করে উঠল। বেনগাজিতে আমি যে এলাকায় থাকি, জায়গাটা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটারের মতো দূরে। আশেপাশে তিন-চার কিলোমিটার পর্যন্ত একটা কাকপক্ষীও থাকে না। সব পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি। আইএসবিরোধী যুদ্ধের সময় পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। এখনও কেউ ফিরে আসেনি।

এই এলাকায় কোম্পানির বিশাল কম্পাউন্ডের ভেতর আমরা মাত্র পাঁচজন মানুষ থাকি – তিনজন বাংলাদেশী, দুইজন ফিলিপিনি। সাধারণ অবস্থায় সেফটি গার্ড হিসেবে দুইজন লিবিয়ান থাকে, কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে কার্ফিউর কারণে তারাও আসে না। এরকম জায়গায় রাত-বিরাতে কান্নার আওয়াজ আসলে সেটা ভয়েরই কথা।

আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা কী। পেঁচা বা অন্য কিছুর ডাক না তো? কিছুক্ষণ পরেই দ্বিতীয়বার শুনতে পেলাম শব্দটা – নাহ, অন্য কিছু না। অবিকল মানুষের কান্নার মতো আওয়াজ। যেন কেউ ভয়ংকর বিপদে পড়েছে। ডাকছে সাহায্য করার জন্য।

আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এরকম অবস্থায় সবচেয়ে বুদ্ধিমানের মতো কাজ হচ্ছে চুপ করে লাইট বন্ধ করে শুয়ে দোয়া-দুরূদ পড়া। অথবা আশেপাশের সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা। কিন্তু আমি তার কিছুই করতে পারলাম না। কান্নার অশরীরী আওয়াজ যেন আমাকে নিশির ডাকের মতো টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। নিজের অজান্তেই আমি রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে হাঁটতে শুরু করলাম ঘোর লাগা মানুষের মতো। ছুটতে শুরু করলাম কান্নার আওয়াজের উৎসের দিকে।

মেইন গেটে তালা মারা ছিল। দরজা টপকে আমি কম্পাউন্ড ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। বহুদূর পরপর একটা-দুইটা ল্যাম্পপোস্টের আলো মিটমিট করে জ্বলছে। অপার্থিব একটা জগত। এর মধ্যেই বুঝতে পারলাম কান্নার আওয়াজটা আসছে গেটের বাইরে মেইন রোডের উল্টোদিকে যে অর্ধসমাপ্ত চাইনিজ কনস্ট্রাকশন প্রজেক্টটা আছে, সেখান থেকে। দেয়াল টপকে আমি প্রজেক্ট এরিয়ার ভেতর ঢুকে পড়লাম।

যতোই কাছে যেতে লাগলাম, ততই আওয়াজ পরিষ্কার হতে লাগলো। মনে হলো ছোটো একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। আর সেটা আসছে ঠিক সেই বিল্ডিংটার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে, যেই বিল্ডিংটা ছিল এই এলাকায় আনসার আশ্‌শারিয়ার সর্বশেষ ঘাঁটি। বছর দুয়েক আগে জেনারেল হাফতারের বাহিনীর নির্বিচার বিমান হামলায় বিল্ডিংটা পুরো ধ্বসে পড়েছিল। মারা গিয়েছিল আনসার আশ্‌শারিয়ার সব সদস্য, সেই সাথে তাদের পরিবারের বেসামরিক সদস্যরাও, এবং অন্তত একটা ছোট বাচ্চাও।

আমার মনের মধ্যে অজানা আশঙ্কা উঁকি দিতে লাগলো। এই কান্না কি ধ্বংসস্তূপের ভেতর অলৌকিকভাবে বেঁচে থাকা কোনো বাচ্চার কান্না? নাকি বিমান হামলায় নিহত সেই শিশুর অশরীরী আত্মার অতৃপ্ত আর্তনাদ? ভাবতে ভাবতেই আমি ধ্বংসস্তূপের একেবারে কাছে পৌঁছে গেলাম। এতক্ষণে শব্দটা আরো পরিষ্কার হয়েছে – আওয়াজটা আসছে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে।

শব্দের উৎস অনুমান করে আমি ধ্বসে পড়া একটা দেয়ালের আড়ালে উঁকি দিলাম। এবং কী আশ্চর্য – আসলেই সেখানে শুয়ে আছে একেবারে সদ্য জন্মগ্রহণ করা এক ফুটফুটে শিশু! আমাকে দেখেই বাচ্চাটা কান্না থামিয়ে দিলো। চোখ বড় বড় করে প্রথমে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এরপর যে ঘটনাটা ঘটল, সেটার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।

বাচ্চাটা ম্যাজিকের মতো শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার লিবিয়ান আরবিতে বলল, আন্দেক ভাইরুস করোনা? অর্থাৎ, তোমার কি করোনাভাইরাস আছে?

আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুলো না। শুধু মাথা এপাশ ওপাশ করে জানিয়ে দিলাম, না, আমার করোনাভাইরাস নেই।

বাচ্চাটার গলার স্বর ততক্ষণে আর বাচ্চার মতো নেই। বয়স্কদের মতো ভারী, গুরুগম্ভীর স্বরে সে বলতে শুরু করল, ক্যান মাতিব্বিশ তামুত, ওগওদ ফিল হোশ। ওয়া আগ্রা কেসাস আল-জাওয়াসিস। আগ্রা কেসাস আল-জাওয়াসিস। কেসাস আল-জাওয়াসিস … বলতে বলতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে বাচ্চাটা মাটিতে ঢলে পড়ল।

সাথে সাথে আমার ঘোর কেটে গেল। কোথায় আমি? কী করছি এখানে? কী দেখলাম এইমাত্র? হঠাৎ করেই অকল্পনীয় আতঙ্ক এসে আমাকে গ্রাস করল। কোনোদিকে না তাকিয়ে উল্টোদিক ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলাম বাসার দিকে।

মেইন রোড পার হওয়ার সময় হঠাৎ করেই দূরে দুইটা হেডলাইট জ্ব্লে উঠল। সম্ভবত হাফতারের আর্মি। কার্ফিউ বাস্তবায়িত করার জন্য রাস্তা পাহারা দিচ্ছিল। আমাকে থামার নির্দেশ দিলো। কিন্তু আমার থামার উপায় নাই। দেয়াল টপকে আমি ঘরে এসে ঢুকলাম।

এই লেখাটা যখন লিখছি, ততক্ষণে হাফতারের আর্মি আমাদের ক্যাম্প চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। তারা হ্যান্ডমাইক দিয়ে আমাকে নির্দেশ দিচ্ছে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য। সম্ভবত কার্ফিউ ভঙ্গ করার দায়ে আমার ছয় মাসের জেল হয়ে যাবে। অথবা ৩,০০০ দিনার জরিমানা। কিন্তু সেটা চিন্তা করার মতো সময় এখন আমার নাই। গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বিশ্ববাসীকে আমার জানিয়ে দিতে হবে, বাচ্চাটা মরার আগে আমাকে কী বলে গিয়েছিল।

বাচ্চাটা বলেছিল, যদি করোনাভাইরাসের কারণে মরতে না চাও, তাহলে ঘরে বসে থাক। হোম কোয়ারান্টিনে থাক। আর পড়তে থাক “কেসাস আল-জাওয়াসিস”। এটাই হচ্ছে করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।

জ্বী প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে আপনাকে এই কাজটাই করতে হবে। বাসায় বসে থাকতে হবে। আর সময় কাটানোর জন্য পড়তে হবে “কেসাস আল-জাওয়াসিস।”

আর্মি দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে গেছে। তাদের একে-ফোর্টি সেভেন তাক করে আছে আমার দিকে। হ্যান্ডগ্লাভস আর মাস্ক পরা এক সেনা সদস্য এগিয়ে আসছে আমার দিকে। এখুনি আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। আপনাদের সাথে হয়তো আমার আবার দেখা হবে ছয়মাস পরে। ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকতে পারলে। আপাতত বিদায় …

ওহ, বাইদ্যওয়ে, “কেসাস আল-জাওয়াসিস” শব্দটা আরবি। এর ইংরেজি হচ্ছে স্পাই স্টোরিজ

বিঃদ্রঃ এটা স্যাটায়ারিক্যাল আর্টিকেল। ২৭ মার্চ ইন্টারনেটে একটা গুজব ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল যে, কোন জায়গায় নাকি একটা বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করেই দাঁড়িয়ে গিয়ে উপদেশ দিয়েছে কীভাবে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। সেটাকে ব্যাঙ্গ করেই এই গল্পটা লেখা হয়েছে।

Mozammel Hossain Toha
Mozammel Hossain Toha

জন্মের পর থেকেই লিবিয়ায় আছি। ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি একেবারে সামনে থেকে। আর সে কারণেই পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আগ্রহ গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে ঘিরে।

নিয়মিত লেখালেখি করছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আলোচনা করছি ইউটিউবে। এখন পর্যন্ত তিনটা বই প্রকাশিত হয়েছে: স্পাই স্টোরিজ, স্পাই স্টোরিজ ২ এবং গল্পগুলো সিরিয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *